ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মাননীয় বিচারপতি আপনাকে বলছি

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৬ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১২
মাননীয় বিচারপতি আপনাকে বলছি

হাইকোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশের অনেক মানুষের মতো আমারও খুব প্রিয় একজন। দেশের মানুষের বিবেকের মতো তিনি অনেক কথা বলেন, আদেশ দেন।

জনগুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে সুয়োমটো রুলের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল মানুষজনকে আইনের প্রটেকশন দেওয়ার চেষ্টা করেন। তার কোর্টে বিচারপতির এজলাসকে লক্ষ্য করে ট্রে ছুঁড়ে মারার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। অকাজটি করেছিলেন একদল মস্তান আইনজীবী। দলীয় আনুগত্যে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তাদের পক্ষ নেন। এরপর আদালতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরও আদালত ক্ষমাও করে দিয়েছেন। যদিও ওই ঘটনায় ক্ষমার বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত হতে পারিনি। আইনজীবী ছাড়া আর কেউ এমন ঘটনা করে ক্ষমা পেতেন কিনা তা নিয়ে লিখেছিও।

দেশে সাম্প্রতিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের একটি রুল নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে কোথায় কাকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব, কোথায় সম্ভব না, এমন একটি অপ্রত্যাশিত মন্তব্যেরও তীব্র প্রতিক্রিয়া চলছে সারা দেশজুড়ে। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা শাসকদলের কোন নেতাও এ নিয়ে দ্বিতীয়বার পুনরুক্তির চেষ্টা করেননি। বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়াও দায়িত্বহীনভাবে বলে ফেলেছেন, এ খুনের  সঙ্গে সরকার জড়িত। ভাবখানা যেমন তিনি ক্ষমতায় থাকতেও খুনের সঙ্গে সরকার এমন জড়িত থাকত! আদালতের মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন, তদন্তে সন্তোষ আর বিরোধীদলের নেত্রীর উক্তির সমালোচনা করা হয়েছে। বিষয়টির অবশ্য খুব মার্জিত একটি জবাব দিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

হত্যার ঘটনার রিপোর্ট নিয়ে গণমাধ্যমের কিছু রিপোর্টের সমালোচনা আছে আদালতের রুলনিশিতে। হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে কোন কোন মিডিয়ার রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে ‘জজ মিয়া প্রস্তুত’, ‘জজ মিয়া খোঁজা হচ্ছে’ সহ তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে— এমন সংবাদ প্রকাশ না করার বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে তথ্যসচিবের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত’। সম্মানিত বিচারপতিদ্বয় এবং আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এ ধরনের আদেশের নানা প্রতিক্রিয়া হতে পারে। অনেকটা পাগলকে সাঁকো না নাড়াতে বলার মতো। দেশের প্রশাসন-পুলিশ-মিডিয়ার এসব সদর অন্দর আমরা জানি। এর চেয়েও বড় বিষয় এসবের কোনকিছুই কোন বিচ্ছিন্ন গ্রহ অথবা দ্বীপভূক্ত নয়। সমাজের পাপতাপ আমাদের সবাইকেই স্পর্শ করে। বাংলাদেশের বিচারপতিদের আইন জানতে হয়, একজন ডাক্তারকে কমপক্ষে এমবিবিএস পাশ, প্রকৌশলীকে সংশ্লিষ্ট শাখায় ডিগ্রিপ্রাপ্ত হতে হয়। কিন্তু রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, সাংবাদিক যেন সকল কাজের কাজী! এর মধ্যে বিশৃংখল রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেক পেশার মানুষের মতো আমরা সাংবাদিকদের বেশিরভাগও হাতুড়ে ডাক্তার। বেশিরভাগ সাংবাদিক অথবা মিডিয়ার লোকজন আমরা সংশ্লিষ্ট শাখায় পড়াশুনার গুণে নয়, কাজ করতে করতে শিখেছি এবং এখানে চলে এসেছি এবং কেউ কেউ দাপটেই আছি।
 
পত্রিকায় অনেক কিছু আমরা লিখি বা ছাপা হয়, সংশ্লিষ্ট আইনকানুন ঠিকমতো জানলে তা লিখা বা ছাপা সম্ভব ছিল না। আমাদের রিপোর্টের বেশিরভাগ সাবজেক্ট খারাপ মানুষ। তারা নিজেরাই দৌড়ের ওপর থাকে। তাই আমাদের এসব লেখালেখিকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিতে যেতে চায় না। যেমন চলতি জজ মিয়া বিষয়ক রিপোর্টের প্রতিবাদ করতে পারেনি পুলিশ। কারণ আলোচিত জজমিয়া উপাখ্যানটি পুলিশেরই সৃষ্টি। বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে আটক অনেক নিরপরাধ মানুষের বন্দিদশার পেছনেও এমন জজমিয়া উপাখ্যান জড়িত আছে। এসব মাঝে মাঝেই আদালত এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই চিহ্নিত-প্রমাণ ও উদ্যোগেই মুক্তির পর একটি মানবিক রিপোর্টের ব্যবস্থা হয়। সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি নিয়ে এর মাঝে মিডিয়ায় অনেক দায়িত্ব কাণ্ডজ্ঞানহীন রিপোর্টও ছাপা হয়েছে। রুনি একজনকে এসএমএস করে তার বউকে ডিভোর্স দিতে বলেছে, মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে সূত্রবিহীন এমন রিপোর্টও ছাপা হয়েছে, মরে যাওয়াতে রুনি এসে তার ব্যাখ্যা দিতে বা এর প্রতিবাদও করতে পারবেন না।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে মিডিয়ার লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, আবার মিডিয়ার হাতেই এমন দ্বিতীয় দফা খুন হয়েছেন সাগর-রুনি। আদালত শুধু জজমিয়া বিষয়ক রিপোর্টকে আমলে নিয়েছে। এর সঙ্গে বৃহস্পতিবার (১-০৩-২০১২) মানবজমিনে ছাপা ‘সাগর-রুনি হত্যা তদন্ত যাদের জীবনে অভিশাপ’ শিরোনামের রিপোর্টটিও আমলে নেওয়ার আবেদন করছি। এই রিপোর্টে ইঙ্গিত আছে আসলে এ মামলার তদন্ত নিয়ে কী করছে পুলিশ। যখন কিছু পারে না বা পায় না, মানুষ ধরে পিটিয়ে এভাবে স্বীকারোক্তি আদায় যেন বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থাগুলোর মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাগর-রুনি মিডিয়ার মানুষ হওয়াতে এ নিয়ে আমাদের নজর বেশি। এমন আমজনতার ঘটনা আমাদের নজরের অগোচরে থেকে যায়।
 
আমি সব সময় নিজেদের নেতিবাচক দিকগুলো আগে বলি। ইতিবাচক দিকটায় পরে আসি। মাননীয় বিচারপতি, এখন একটু পজিটিভ দিক বলি। নিজেকে নিজেই হাতুড়ে ডাক্তার বলেছি, কিন্তু দেশের মানুষ এবং আদালতপাড়ার বাসিন্দারাও জানেন, মিডিয়ার সকল সদস্যই কিন্তু হাতুড়ে ডাক্তার নন। অনেক ভালো মেধাবী, দেশপ্রেমিক মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং আছেন। আইনপেশার লোক না হয়েও আদালত বিটের বেশিরভাগ রিপোর্টারই যে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে যে রিপোর্ট করেন, আদালতপাড়ার লোকজনই তার সাক্ষী। সারাদেশের মানুষের মতো আদালতপাড়ার বাসিন্দারাও তাদের রিপোর্ট পড়ার-দেখার অপেক্ষায় থাকেন।
 
পুঁজির চরিত্র, কালাকানুন, অলিখিত অথবা সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যেও দেশের মিডিয়া অনেক স্বাধীনতা ভোগ করছে। স্বাধীনতা মানুষকে দায়িত্বশীলও করে। দায়িত্বটি সততার-স্বচ্ছতার, তা নিজের বিবেক আর পাঠক-অডিয়েন্সের কাছে। যে মিডিয়া যত বেশি দায়িত্বশীল সে তত পাঠকপ্রিয়-জনপ্রিয় হয়। সে জনপ্রিয়তা-গ্রহণযোগ্যতা অটুট রাখতে সতর্ক চলতে হয় সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকে। কাজেই দেশের সব রিপোর্টারই কাল্পনিক জজমিয়ার কাহিনী লিখেন না। বা সব মিডিয়া তা ছাপবেও না।

এরপরও বরাবর প্রভাবশালীদের কাছে আক্রান্ত-নিগৃহীত হয় মিডিয়া। বাংলাদেশে গত একদশকে যত চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, আজ পর্যন্ত এর একটারও বিচার শেষ হয়নি। বাংলাদেশের কোন আদালত এ বিষয়ে কোন সরকারের উদ্দেশে কোন রুলনিশিও জারি করেনি। বাংলাদেশে এর আগে এত মিডিয়ার প্রিয় একটি সরকার ক্ষমতায় এসেছিল কীনা জানি না। সেটি বর্তমান সরকার। কিন্তু সেই সরকারটিও এখন দেশের জনপ্রিয়-পাঠকপ্রিয় মিডিয়াগুলোকে সারাদিন শত্রু মনে করে। দায়িত্বের খাতিরে দেশের প্রধান সব ইস্যুকে মিডিয়ার যথাযথ অনুসরণ করে চলতে হয়। সরকারি লোকজনের গাফিলতি-অজ্ঞতা অথবা দুর্নীতি শনাক্ত হলে সরকার ক্ষিপ্ত হয়। অনিয়মের প্রতিবিধান করে না বা করতে পারে না, মিডিয়ার উদ্দেশে হাতপা ছোঁড়ে! প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারি দলের লোকেরা সুযোগ পেলেই গোষ্ঠী উদ্ধার করেন মিডিয়ার! সে দেশের সরকারের তথ্য সচিবকে যদি আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটা একটা কিছু করার নির্দেশ দেন, এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখন না হোক ভবিষ্যতে কোথায় ঠেকতে পারে?

মিডিয়ার মানুষ হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা, এর প্রতিক্রিয়া ভালো হওয়ার নয়। সরকার সুযোগমতো এর অপব্যবহার অথবা ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে। কারণ যারা আদালতের নির্দেশ পালন করবেন তারা ফেরেস্তা নন। পক্ষে-বিপক্ষের মিডিয়াকে শায়েস্তার ডিএফপির বিজ্ঞাপনের টাকা লুটপাট এই তথ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বই হয়। দেশের মিডিয়া সংক্রান্ত কোন আইন, প্রেস কাউন্সিল এসবও অকার্যকর অবস্থায় নেই। এর মাঝে দেশের প্রধান সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আদালতের ভূমিকার বিরুদ্ধে বলেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের খুনিদের গ্রেফতার বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের গণঅনশন কর্মসূচিতে গণমাধ্যমে আদালতকে নাক না গলাতে বলেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। আমার প্রিয় একজন বিচারপতির বেঞ্চের একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে এমন সব বক্তব্য আসা শুরু করেছে, এটি মোটেই আনন্দের নয়। মাননীয় বিচারপতি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমার এ লেখাটির মূল ম্যাসেজ। আমার মনে হয়েছে, আদালত এ ক্ষেত্রে ঠিক কাজটি করেনি। জজমিয়া নাটক পুলিশ না সাজালে মিডিয়ায় তা জোর করে লেখা সম্ভব নয়।

লেখক: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।