ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতার পতাকাউৎসবে তোফায়েল কেন প্রধান অতিথি?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১২
স্বাধীনতার পতাকাউৎসবে তোফায়েল কেন প্রধান অতিথি?

মার্চের ২ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনের কাছে স্বাধীনতার পতাকাউৎসব হয়েছে। গত বছর থেকে হঠাৎ করে শুরু করা হয়েছে উৎসবটি।

কেন কারা হঠাৎ এই উৎসবটি চালু করেছেন সে গবেষণায় না গিয়েই বলা যায়, নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে এ ধরনের উৎসবের গুরুত্ব আছে।

কিন্তু গত দু’বছরের আয়োজন দেখে মনে হলো এর পিছনে প্রকৃত ইতিহাস না, কাজ করছে দলবাজি! না হলে একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে পতাকা উত্তোলনকারী তৎকালীন ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রবকে উৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নেওয়া হয়নি কেন?

স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছিলেন ডাকসুর তৎকালীন জিএস শাহজাহান সিরাজ। এভাবে এ দু’জন ইতিহাসের অংশ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তাদের যদি এসব অনুষ্ঠানে উপেক্ষিত রাখা হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কী শিখবে নতুন প্রজন্ম?

জাতীয় পতাকা উত্তোলনের স্থানটি অমর করে রাখতে এবারে সেখানে একটি ম্যুরাল স্থাপন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আসম আব্দুর রবকে সেখানেও ডাকা হয়নি। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সময়ের কেবিনেটের মন্ত্রী ছিলেন আসম রব। এবার  নেই। এবার তিনি মন্ত্রী থাকলে কী তাকে অবজ্ঞা কর পারতেন ঢাবি’র সরকার সমর্থক উপাচার্য? শিখা চিরন্তনের পতাকাউৎসবের প্রধান অতিথি ছিলেন উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থানের মহানায়ক তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীনতার পতাকাউৎসবে তোফায়েল আহমেদ অবশ্যই থাকবেন, কিন্তু কিন্তু আ স ম রব বেঁচে থাকতে তিনি কী করে পতাকাউৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে গেলেন? তার কাছে প্রস্তাব যারা নিয়ে গিয়েছিল তিনি কী তাদের তখন বলেছেন যে, আমাদের সবার পক্ষে পতাকা তুলেছে রব, তাকে সেখানে চিফ গেস্ট করে নিয়ে যাও। আমাকে না। তোফায়েল আহমেদ এমন বললে কী উদ্যোক্তাদের ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ হতো? এভাবে ইতিহাসে স্থান পাওয়া ব্যক্তিরাই যদি ইতিহাসে যার যা অবদান, তা তাকে দেবার উদ্যোগ না রাখেন, প্রকৃত ভূমিকা না নেন, তাহলে নতুন প্রজন্ম কী করে জানবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস?
 
মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের এমন অনেক ভূমিকা আমাদের আহত করে। আব্দুর রাজ্জাক মারা যাবার পর তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তার নেতা ছিলেন রাজ্জাক। ১/১১ কালীন ভূমিকার কারণে চলতি শাসন কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতা আব্দুর রাজ্জাকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। তার এমন মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, ‘রাজ্জাকই ছিলেন আমার নেতা’, তোফায়েল আহমদের এমন উক্তি তাকে সহানুভূতি এবং একইসঙ্গে শেখ হাসিনার আরও ক্রোধ দিয়েছে ঠিক,  কিন্তু ইতিহাস তো বলে এক সময় এদের সবার নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবার রাজনৈতিক গুরু, কিন্তু ছাত্রনেতাদের মধ্যে যে মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি হয় আর এর নিরবে গোপনে পরিচর্যাটি চলছিল, সিরাজুল আলম খান ছিলেন পুরো প্রক্রিয়ার নেপথ্যের নেতা। সেখানে সিরাজুল আলমের পরেই ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, এরপর রাজ্জাক-তোফায়েলসহ অন্যরা। স্বাধীনতার এই নিউক্লিয়াস থেকেই স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি, ইশতেহার তৈরি, কে পতাকা তুলবেন, কে ইশতেহার পড়বেন, এর সব ঠিক করে দেয়া হয়।
 
এসবের আগে থেকে কলকাতায়-আগরতলায় লোক পাঠিয়ে জানার চেষ্টা হচ্ছিল, আক্রান্ত হলে ভারতীয়দের তরফে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে কিনা। এমন অনুসন্ধান মিশনে একাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকেই আগরতলা যাওয়া আসা করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন ছাত্রলীগনেতা ও পরবর্তিকালের মুক্তিযোদ্ধা-এমপি লুৎফুল হাই সাচ্চু। আব্দুল কুদ্দুস মাখন ঢাকায় ছাত্রলীগনেতা থাকায় সিরাজুল আলম খান’রা এ ব্যাপারে তার মাধ্যমে আগরতলায় দূতিয়ালির জন্য সাচ্চুকে নির্বাচিত করেন। স্বাধীনতার নিউক্লিয়াসের উদ্যোগে তখন আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃ্ত্বে গড়া হয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। পরে এটিই জয়বাংলা বাহিনী নামে সম্ভাব্য পাকিস্তানি হামলার প্রতিরোধ প্রস্তুতি, ‘‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’’ স্লোগানে শুরু করে বেসামরিক প্রশিক্ষণ। একাত্তরের ২ মার্চের পর থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারাদেশে ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হলেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে পতাকাটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে তোলা হয় ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে।
 
এমনকী মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই প্রক্রিয়ার অনুসারীরা পৃথকভাবে মুজিববাহিনীর গঠন করেন। তাজউদ্দিনের নেতৃ্ত্বাধীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সঙ্গেও মুক্তিযুদ্ধের ছাত্র নেতৃ্ত্বের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এসের মাঝে আবার যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে বিজয়ের গৌরব একচেটিয়া চলে যায় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃ্ত্বে। মুজিববাহিনীওয়ালারাও তাই তাদের পৃথক অস্তিত্ব সৃষ্টি চেষ্টার গোপন উদ্যোগটিও চেপে যান। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের বিভক্তিকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্রনেতারাও ভাগ হয়ে যান। জলিল-রব-শাহজাহান সিরাজ-ইনু এদের নেতৃ্ত্ব জাসদ গঠিত হলে স্বাধীনতার ছাত্রনেতৃ্ত্বের বিভক্তি-কাজিয়া চরমে পৌঁছে। সেই ভাগাভাগির জের এখনও চলছে। সে কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্ব তথা তোফায়েল আহমেদের কাছে এরশাদ জায়েজ হয়ে গেলেও তার সঙ্গে যাবার অপরাধে আজও আ স ম রবদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে নি। পতাকা উৎসবেও তাই তার দাওয়াত হয় না!

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জাসদ গঠনের নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এরপর পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডে জাসদের রাজনৈতিক কর্তৃ্ত্বের স্বপ্ন আরও হাতছাড়া হয়। ৭ নভেম্বরে জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করে তার নেতৃ্ত্বে অভ্যুত্থান, এরপর আবার ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণের মতো হঠকারিতায় আরও লণ্ডভণ্ড হয় সিরাজুল আলম খান অ্যান্ড কোং! এরপর এই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু ‘দাদা’ আরও চরম একটি রাজনৈতিক ভুল করেন এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর। এরশাদকে সমর্থন করা নিয়ে রব, শাহজাহান সিরাজ, ইনু’র নেতৃ্ত্বে জাসদ আবার ভাগ হয়। সিরাজুল আলম খানের সমর্থনপুষ্ট রব গং এরশাদের ছায়া আর গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা হয়ে যান। ইনুরা থাকেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। শাহজাহান সিরাজের নেতৃ্ত্বাধীন গ্রুপটি পরে বিএনপিতে বিলীন হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে আ স ম রবকে মৎস ও পশুসম্পদমন্ত্রী করা হয়। এখন আবার রাজনৈতিকভাবে তিনি কারও সঙ্গে নেই। ইনু’র নেতৃ্ত্বাধীন অংশটি মহাজোটের ব্যানারে পার্লামেন্টের তিনটি আসন পেলেও শেখ হাসিনার কৌশলের ফেরে পড়ে মন্ত্রিত্ববঞ্চিত।
 
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃ্ত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের অনেকের এই মোটামুটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আব্দুর রাজ্জাক মারা যাবার পর তার জন্য বিশেষণের অভাব হয়নি। সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, শাহাজাহান সিরাজ এদের নানা ভূমিকা নানান প্রশ্ন, লক্ষ্যচ্যুতিযুক্ত হলেও এটা কী বলা সম্ভব যে, এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছিলেন না? বা এরা স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন? নাকি আব্দুর রাজ্জাকের মতো এরাও মারা গেলে তাদের শোকবাণীতে উপমা-বিশেষণের অভাব হবে? পরে রাজনৈতিকভাবে এরা যে যেখানে যান বা থাকেন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার জন্য এদেরকে কেন তাদের প্রাপ্য সম্মানুকুও দেয়া হবে না? ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকাউৎসব, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ উপলক্ষে অনুষ্ঠান কেন তাদের বাদ দিয়ে হবে হবে? এই প্রশ্নটি রাখা হলো সংশ্লিষ্ট সবার কাছে। মুক্তিযুদ্ধে সবার ভূমিকা সম্মান পাক। কারন এই সবার সম্মিলিত ভূমিকাতেই আমরা আমাদের এই দেশ পেয়েছি।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১৫৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।