ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মেঘের `পরে মেঘ জমেছে

ফারজানা খান গোধুলি, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১২
মেঘের `পরে মেঘ জমেছে

আল্লাহর ফোন নাম্বার জানো তাঙ্কা? তাঙ্কা চমকে উঠলেন। পাশে তাকিয়ে দেখলেন তীব্র প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে ছোট্ট এক বালক, মেঘবালক।

কষ্ট চোখের পানি লুকালেন, কি উত্তর দেবেন তাঙ্কা, উত্তর তো জানা নেই। তাঙ্কা মামা জিজ্ঞেস করেন কেন বাবা? কি করবে ফোন নাম্বার নিয়ে? ছোট্ট মেঘ মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, `একটু জানতাম চিকিৎসা শেষ হইছে নাকি? কবে আসবে মাম্মি-বাবা। `

অসহায় তাঙ্কা অশ্রু লুকাতে বুকে চেপে ধরেন মেঘকে। তাঙ্কা বলেন, `ওরা তো আর আসতে পারবে না, আল্লাহর কাছে ওরা ব্যস্ত আর ভালো আছে। ` মেঘ আবারো জানতে চায়, `ওখানে কি আরেকটা মেঘ আছে?` তাঙ্কা হতবিহব্বল হয়ে যান। ওর এ প্রশ্নে যে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে, এই প্রশ্নের মাঝে আরও অনেক প্রশ্ন জমা আছে। ওকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে বাবা-মা কি করে ভালো আছে? বাবা-মা মেঘ ছাড়া থাকতে পারে না, তারা কেন আসে না আল্লাহর কাছ থেকে। মেঘ যখন কথা বলা শেখে তখন, রুনির মেঝ ভাই রোমানকে মামা না বলে তাঙ্কা ডাকে। দুরন্ত মেঘ, আজ শান্ত। চাপা স্বভাবের মেঘ আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মেঘের জীবনযাপন কিছুটা স্বাভাবিক লাগলেও ওর ভিতরে চলছে অনেক ভাংচুর। অনেক তোলপাড়। চাপা স্বভাবের কারণে মনের কথা না বললেও ওর অস্থিরতায় মেঘের মামা ও নানি টের পান অনেক কিছু। হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেছে ছটফটে শিশুটি। শিশুমনে মেঘ জমেছে। মেঘের `পরে মেঘ জমেছে।

ক`দিন আগে বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টার দিকে, রোমানকে ফোন করি মেঘ কেমন আছে জানার জন্য। রোমানের সাথে কথা বলছিলাম, হঠাৎ মেঘ চাইলো কথা বলতে। আমাকে জিজ্ঞেসা করল,`তুমি কে?` `আমি একটা আন্টি` বলতেই সে স্কাইপি তে আমাকে দেখতে চাইলো। ও যেন দেখতে চাইছে ফোনের ওপারে মা কিনা। ভিডিও চ্যাট করলাম, আমি আর মেঘ। ওর অনেক কথা সে বলল আমার সাথে। ‘আমি কমপিউটারে গেমস খেলি। আজ স্কুলে যাইনি। বাইরে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ফুলের সাথে খেলেছি’ এইসব।

ওর ছোট্ট মামাত বোনকে দেখিয়ে বলল, `জানো এটা আমার বোন। আমি আজ স্কুলে যাইনি। ` এরই মাঝে রুনির আম্মা দুধ আনলেন এক মগ। মেঘ কথা বলে। আমি এখন খাবো না । রোমান জানায় মেঘ কিছুই খেতে চায় না এখন। অনেক কষ্ট করে ওকে খাওয়াতে হয়। আমি মেঘকে বললাম, `বাবু তুমি তো সুপারম্যান খেয়ে নাও জলদি। সুপারম্যানরা খুব দুধ পছন্দ করে। দুধ খেলে তুমি অনেক শক্তিশালী হয়ে যাবে। তুমি দুধ খেলে তারপর আমি তোমার সাথে গল্প করব। ` মেঘ দুধ দুই মিনিটে শেষ করে। তারপর সে আমাকে বলে, `দুধ শেষ এখন আমি গেমস খেলব। ` কথা শেষ করার আগে হঠাৎ বলল, `জানো আমার মা-বাবা আল্লাহর কাছে চলে গেছে, এখনো আসেনি। ` আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কী বলা উচিৎ বুঝে পাচ্ছিলাম না। মেঘই আমাই উদ্ধার করে স্তব্ধতা থেকে। আমাকে বলে, `শোন, পরে কথা বলবো। আমি এখন খেলব। ` মেঘ ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
 
রোমান আমাকে বলে, `মেঘ বাইরের কারো সাথে কথা বলেতে চায় না। আপনার সাথে আজ ও নিজে থেকে অনেক কথা বলল। কেউ ওকে দেখতে এলে রাগ করে। জিগ্যেস করে, কেন ওরা আমাকে দেখতে আসছে। আমি তো ভালো আছি। ` ভালো থাকলেও সে প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করে মা-বাবার।

দরজাতে নক করার শব্দ হলে ভাবে মা-বাবা আসছে। ছুটে যায় দরজা খুলতে। কাউকে মুখে না বললেও ওর শুকনো মুখ বলে দেয়, প্রতিটি ক্ষণ মেঘ থাকে মা-বাবার প্রতীক্ষায়। মেঘ এখনো কিছু ভোলে নি সেই নির্মম ভোরের কথা। ক`দিন আগে নিজেদের ফ্ল্যাটে যেতে চায় মেঘ। পুলিশকে বিল্ডিংয়ের নিচে রেখে, মামার হাত ধরে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢোকে মেঘ। নিজের ঘর থেকে দুটো খেলা নেয়। মামা বলে, `চল বাবা-মার রুমে গিয়ে বসি। ` কিছুতেই রাজি হয় না, মামাকে জড়িয়ে ধরে। মা-বাবার ঘরের দিকে তাকায় না মেঘ। জোর করে ফিরে আসে নানাবাড়িতে। যে মেঘ বাবা-মার পাশের ঘরে একা ঘুমাত, সেই ছেলেটি এখন এক মুহূর্ত একা থাকতে পারে না। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। ইদানিং চোরের ভয় বেড়ে গেছে অনেক। ঘুমের মাঝেও ভয় পায়। তাঙ্কা (রোমান) কে কিছুতে কাছ ছাড়া করতে চায় না মেঘ। মেঘ অল্প হলেও একমাত্র রোমানের কাছে মা-বাবা নিয়ে কথা বলে। ১১ মার্চ মেঘ মা-বাবার সহকর্মীদের সাথে মামার হাত ধরে মানববন্ধনে যোগ দেয়। ও বোঝেনি জানেনি কেন দাঁড়ালাম পথে! ও ব্যানারে বাবা-মায়ের ছবি দেখছিলো শুধু। হয়ত ভেবেছিলো ব্যানার থেকে মা-বাবা বের হয়ে আসবে, দাঁড়াবে মেঘের হাত ধরে।

মেঘ বোঝেনি জানেনি কেন মানববন্ধন? কেন সবাই রাস্তায়? ছোট্ট মেঘ না জানলে আমরা তো জানতাম। কেন আমরা সমবেত হয়েছি। ঢাকা শহরে কত জন সাংবাদিকের বাস? আর ক’জন যোগ দিয়েছিলাম এই মানববন্ধনে? শেষ কি আমাদের দায়িত্ব? আমাদের জীবন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুর-তাল-লয়ে আমরা আবার মেতে উঠেছি। কিন্তু ক’জনই বা খোঁজ রাখি মেঘের? ক’জনই বা জানি কেমন কাটছে মেঘের মা-বাবাহীন দিনগুলি? কি করে আমরা ভুলে থাকছি মেঘকে? কেমন করে আমরা ভুলে থাকছি আমদের বন্ধুদের? কিছু দিন আগেও যাদের সাথে আমরা হেসেছি। একসাথে কাজ করেছি। একসাথে খেয়েছি। একসাথে গল্প করেছি। একসাথে ঘুরেছি। সুখ দুঃখের আলাপ করেছি। আমরা কি যান্ত্রিক হয়ে গেছি? আমাদের মানবতা বোধ কি শেষ হয়ে গেছে? না কি আমরা মেনে নিয়েছি, `ভাগ্যের লিখন কে আর খণ্ডাবে`? তাই যদি হয় তবে আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, সাগর-রুনির মত আমাদের যে কেউ যেকোনো দিন নির্মম হত্যার শিকার হতে পারি। তখন কেউ পাশে এসে দাঁড়াবে না। যদি আজ আমরা সাগর-রুনির জন্য সোচ্চার না হই। আমাদের দেশে সাত খুন মাফ হয়, তাই খুন হতে না চাইলে আসুন খুনির ধরার জোরালো দাবি জানাই। কঠোর কর্মসূচি দিই। সাগর-রুনি প্রাণ দিয়ে বিভক্ত সাংবাদিকদের এক করে দিয়েছে। একতাই বল। একতাই শক্তি। সেই শক্তি আমরা কাজে লাগাই। বিভক্ত সাংবাদিকদের এক হবার খবরে ভীত অনেকে। আর এই ভয়ের কারণেই হয়ত আমাদের সাগর-রুনিকে নিয়ে লেখনি থামিয়ে দেয়া হয়েছে। লিখতে মানা। আন্দোলন করতে মানা নেই। আসুন আন্দোলন করি। আমাদের কলম, পত্রিকা, চ্যানেলকে আমাদের আন্দোলনের হাতিয়ার করে তুলি। যারা তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের খবর আমরা বয়কট করি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সব অনুষ্ঠান, পুলিশ, গোয়েন্দাসহ যারা অসহযোগিতা করছেন আমরা তাদের বয়কট করি। এটাতো করতেই পারি। আর যদি আমাদের বিবেক ঘুমিয়ে পড়ে মিডিয়ার মালিকদের রক্তচক্ষুর ভয়ে, তাহলে আমাদেরও ভবিষ্যৎ নিতান্তই অন্ধকার। আমাদের ঐক্যের শক্তি দেখানোর সময় এখন। আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। পিছিয়ে পড়ার বা থেমে যাবার কোনো অবকাশ বা অজুহাত নেই। সাগর-রুনির পাশাপাশি আমাদের আরও যে সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে, সবার বিচার আমাদের চাইতে হবে।
 
তিনদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদিবস ঘোষণা দিলেন। সেই দিন কি উনি একবারও মেঘের কথা বলেছেন। একবারও কি ভেবেছেন অন্তত এই দিন মেঘের খবর নেয়ার কথা। নাকি পৌনে ছয় বছরের মেঘ উনার কাছে শিশু নয়। নাকি উনি লৌকিকতা সেরেছেন । মেঘের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেছেন শুধু জন-সহানুভূতি লাভের আশায়। এরপর একদিনও কি উনি খবর নিয়েছেন কেমন আছে মেঘ বা সাগর-রুনির মায়েরা। যতদূর জানি সাগর-রুনির মায়েরা আর্থিক কারণে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন নি। করেছিলেন সন্তানদের হত্যাকারী গ্রেফতারের অনুরোধ জানাতে। দেখা করেছিলেন ন্যায়বিচারের আশায়। সে আশার গুড়ে বালি।

ক্ষমতাবানরা যতই বালি দিক গুড়ে, ন্যায়বিচার আমাদের আদায় করতেই হবে। আমাদের ঐক্য অটুট রাখতে হবে। আমরা অহিংস আন্দোলন করে ক্ষমতাবানদের কাঁপিয়ে দিতে পারি তা দেখানোর সময় এখন।

আমাদের নেতাদের প্রতি বিনীত আবেদন, যে কোনো মুল্যে আপনারা এক থাকবেন, আমাদের কাছে আপনারাই আদর্শ। আপনাদের কাজ দেখেই আমরা এই মহান পেশায় এসেছি। আপনাদের আজীবন অনুসরণ করতে চাই, করতে যেন পারি, আপনাদেরকেই আদর্শ মানতে পারি সেই পথই দেখাবেন আশা করি। আপনাদের ঐক্য আমাদের এক রাখবে। আমাদের পাশাপাশি সাগর-রুনি, বালুভাই, গৌতমদা, শামসুরভাই সহ সকল সাংবাদিক যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার আপনাদের দোয়া করবে। আপনাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। এমন কী নিজ পরিবারের সদস্যদের কাছে সম্মান পাবো, উপহাস বা চিন্তার কারণ হবো না। সাধারণ জনগণ যারা বিশ্বাস করে আমাদের উপর, তারা আমাদের পেশাকে আরও সম্মান করবে। ওদের সবার চোখে চোখ রেখে আমরা তাকাতে পারব। বুক ফুলিয়ে মেঘরা যেন বলতে পারে আমি বড় হয়ে সাংবাদিক হবো।

ফারজানা খান গোধুলি
ওয়াশিংটন প্রবাসী সাংবাদিক

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।