ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কবিতা

একগুচ্ছ কবিতা | মাহফুজ পারভেজ

কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪০ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৭
একগুচ্ছ কবিতা | মাহফুজ পারভেজ একগুচ্ছ কবিতা

কাপাসিয়া: তোমার সাথে
নদীতে তখন সেতুটি ছিল না:
শীতলক্ষ্যার শরীরে আমাদের ছায়া মিশে গেছে বহুবার

ভেসে গেছি আমরা মাছের সাঁতারে উৎস থেকে মোহনায়-
এইখানে,
এখানে কাপাসিয়ায়,
একটি নীলাভ নদী আছে ভাওয়ালের সবুজ উপান্তে, যেখানে
আকাশ দিগন্ত-নীল নিয়ে খেলা করে সবুজে, শ্যামলে
মাটিতে, উদ্ভিদে, পত্র ও পল্লবে, তোমার ও আমার হৃদয়ে...

নদীতে এখন সেতুটি রয়েছে:
তুমি বা আমি স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারি আমাদের কাছাকাছি
শব্দের পোশাক বদলে দুপুরে মাছরাঙা বিকেলে দোয়েল হয়ে
প্রদোষের প্রজাপতি উড়ালে পৌঁছুতে পারি জোনাকি আলোয়
আমাদের নিজস্ব গল্পের মিথুন প্রহরে-
এইখানে,
এখানে কাপাসিয়ায়,
নদী-নীল, মেঘ-নীল, বৃক্ষ-নীল আলোয় ভাসাতে পারি লুকানো-হৃদয়...

ঘনিষ্ঠতা তোমার-আমার
নদীর ভেতর ছায়ার ভেতর
চেনা-জানা আর হবে আর কবে?
গল্প-কথা তোমার-আমার
জলের ভেতর স্রোতের ভেতর
ভেসে ভেসে শেষ হবে আর কবে:

কাপাসিয়ার আকাশ যখন মেঘের সাথে বেদনার্ত হবে?

চলে এসো একদিন... বিজনের চায়ের কেবিন...
ভিড়ের মধ্যে কে একজন আমাকে বলল-‘চলে যা, দেখা পাবি...’
আর আমি বাসায় না-ফিরে সড়কে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম-
‘তুমি চা খেতে সন্ধ্যায় নেমে আসো পাড়ার চায়ের স্টলে’
মাত্র এইটুকু তথ্য সম্বল করেই আমি যাত্রাবাড়ি থেকে মীরপুর
পর্যন্ত সকল চায়ের দোকান চষে চষে হয়ে গেছি ‘বিশিষ্ট চা বিশারদ’।
আমি এখন মোটেই কফি পান করি না এবং এ কারণে
দেশে কফির চালান কমে গেছে।


চায়ের দোকানিগণ আমাকে চায়ের এজেন্ট ভেবে 
আলাদা সমীহ করে। আমি কিন্তু অনঢ় তোমার খোঁজে
পথ থেকে পথে।
খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে মীরপুর ভালো
ওখানে রূপনগর নামের একটা জায়গা আছে না?
ভাবতে ভালোই লাগে-রূপনগরের রহস্যজগতে ‘বিজনের চায়ের দোকান’!
কিংবা কিছুটা রোমান্টিক হয়ে ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’
ধরনের কোন প্রাচীন সঙ্গীত শুনছি রূপনগরে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে
আর খুঁজছি তোমাকে ‘চলে এলে দেখা পাবো’-এই ভরসায়...
তুমি কিন্তু  কোনো ঠিকানা বা চায়ের  দোকানের নামটি পর্যন্ত বলো নি-
কী এমন দরকার ঠিকানার-চেনা-জানার-সম্পর্ক সূত্রের-পরিচয়ের?
সব কিছু ছিঁড়ে ফেলে 
অচেনা বাতাসে ভাসিয়ে উড়িয়ে চলে এসো-
চলে এসো একদিন 
আমার ডেরায়-যেখানে তোমার খোঁজে আমার অপেক্ষা:  

‘চলে এসো একদিন... বিজনের চায়ের কেবিন...’

দর্শন
মুদিত চক্ষুর গৌতম বুদ্ধকে বলা হলো;
‘মহাত্মন, আপনি কি প্রার্থনা করছেন?’
উত্তরে চোখ না-খুলেই বুদ্ধ বললেন:
‘না, আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি। ’

অহর্নিশি তাকিয়ে দেখে দেখে যাকে 
শত্রু বলে প্রচার করছ, সেই আমি:
তোমার আত্মার পরম আত্মীয়।
এই আশ্চর্য সত্যটি উদ্ধার করতে
আর কতদিন তুমি জেগে থাকবে
জাগ্রত-ঘুমের অন্ধ বাতাবরণে?

আমি জানি না
কীভাবে সম্ভব তোমার প্রকৃত জেগে ওঠা?

চোখ বন্ধ করেও যে সত্য দেখা যায়
সহস্র বছর জেগেও মানুষ তা দেখতে পায় না...  

মির্যা আসাদুল্লাহ গালিব
বিষন্ন বাতাসে মিশে  গানের সুদীর্ঘ মেঘভেলায় ভাসতে চেয়েছিলে
আমাকে তোমার সাথে নিয়ে উড়ে উড়ে যেতে চেয়েছিলে 
ইস্পাহানের আঙুর বাগানের নিঃস্তব্ধ ইবাদতে-
কিন্তু মির্যা গালিব আমাকে আসতে নিষেধ করলেন:
“উপদ্রুত দিল্লি ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না;
দেখো না নগরে পুড়ছে আমার আত্মার পবিত্র পাঠাগার?”
আমি শেষ খেয়া পারাপার ছেড়ে বেতো ঘোড়ার বহর ছেড়ে
বয়সী নৌকার দাঁড় ছেড়ে প্রিয় পাখিদের ডানাগুলো ছেড়ে
লাস্ট ট্রেন ছেড়ে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছি;
আমার সামনে নিয়ে মৈত্রী চলে গেল, গীতাঞ্জলী চলে গেল-
এখন বিরান স্টেশনে বিষের বাঁশী ছাড়া অন্য কোনো সুর নেই
জাফর শাহের কবিতারা ছাড়া অন্য কোনো কাব্য নেই
গালিবের হাহাকার ছাড়া অন্য কোনো বাষ্প নেই-
আমি কী তাহলে কোনো কারাগারে আটকে গিয়েছি? 
কেন তবে ক্রমাগত রাবণের দৈত্যরথে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হচ্ছি?
প্রচণ্ড ‘না’ শব্দে আমাকে কাঁপিয়ে দিলেন জালালউদ্দীন বলখি রুমি:
Why do you stay in prison
When the door is wide and open? 
কারাগার নয়? সব দরজা উন্মুক্ত আর খোলা?
তাহলে যাবার কোনো পথ পাচ্ছি না কেন সামনে বা পেছনে?
লক্ষ্যে স্থির, পন্থা নির্বাচনে চঞ্চল গালিব আবার আমার উজ্জ্বল উদ্ধার:
“শতবার প্রেমের বন্ধন থেকে আমি মুক্ত হলাম
কিন্তু কী করি হৃদয়ই মুক্তির পরিপন্থী। ”

হৃদয়ের মুক্তির অপেক্ষা করতে করতে আমি প্রায়ই দিল্লির একটি দরিদ্র
কবরখানার আবছায়া দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি-
যেখানে শায়িত মির্যা আসাদুল্লাহ গালিব।  

রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ, আপনার কথা ভাবতে ভাবতে আমি
আসলে কার কথা ভাবি কোথা চলে যাই ...

সুচিত্রা মিত্রের মৃত্যুতে আবার রবীন্দ্রনাথের কথা 
চুপ করে বসে বসে ভাবি;
বছর বছর আগে আরেকটি বার ভেবেছিলাম প্রকৃত
ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ, আপনাকে-
জর্জ দা অমৃতলোকবাসী হয়েছিলেন যেদিন।
এইসব মৃত্যু রবীন্দ্র-গানের এক-একটি যুগের 
পর্দা ফেলে নতুন দিনের ডাক দিয়ে যায় আর
আমি চুপ করে বসে বসে ভাবি:
“হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে”

রবীন্দ্রনাথ, আপনার কথা ভাবতে ভাবতে আমি
আসলে কার কথা ভাবি কোথা চলে যাই ...

“আনন্দ বিলাও তুমি
না করি কার্পণ্য।
সুধা কণ্ঠে সুধাগীত
শুনি হই ধন্য॥
মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতৃবৃন্দ
করি নিবেদন-
বারেবারে এসো ফিরে
শান্তিনিকেতন। ”

রবীন্দ্রনাথ, আপনার কথা ভাবতে ভাবতে আমি
আসলে কার কথা ভাবি কোথা চলে যাই ...
এ কথাটি জানার বিশ্বস্ত কোনো লোক চারপাশে দেখতে পাই না!

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৭
এসএনএস


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ