সম্প্রতি প্রকাশিত ‘তৃতীয় অশ্বারোহী’ নিয়ে কবি রাসেল রায়হানের বক্তব্য এমনই। এটি তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
প্রশ্ন ছিলো, সবাই একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, আপনি এর আগে কেন করলেন?
‘আমার আগে দু’টি বই আছে। সেই দু’টিও মেলা ছাড়াই। মেলা ছাড়া বই করায় বেশকিছু পজিটিভ দিক আছে। প্রথমত, আমাদের যে মেলানির্ভর বই প্রকাশের রীতি, তাতে সবসময় বই প্রকাশ হয় না, ফলে ধারাবাহিকতা থাকে না। পাঠকও অবচেতনভাবেই বইটা কেনে উৎসবের আবহে। বইটা আসলে উৎসব না শেষ পর্যন্ত, প্রয়োজন। ’
আরও বলেন, যেহেতু মেলায় অজস্র বই বের হয়, সুতরাং তখন প্রকাশকদের চাপ থাকে, বাঁধাইখানায় চাপ থাকে, সব জায়গাতেই চাপ থাকে, ফলে বইটা সুন্দর আর নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
তৃতীয়ত, মেলার বাইরে যেহেতু তেমন বই হচ্ছে না, ফলে সহজেই আমার বইটির দিকে মানুষের দৃষ্টি পড়ে। এটা অবশ্য সাময়িক লাভ। আস্তে আস্তে এভাবে বই প্রকাশ বাড়বে। এমন অজস্র কারণ আছে, এবং প্রায় সবগুলোই পজিটিভ কারণ, যোগ করেন তিনি।
তৃতীয় অশ্বারোহীর প্রকাশক জেব্রাক্রসিং। এর প্রচ্ছদ করেছেন সারাজাত সৌম এবং বিনিময় মূল্য ১২০ টাকা।
বইটি মিলবে- রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের দোতলায় লোক ও চট্টগ্রামের বাতিঘরে এবং অনলাইন বুকশপ বইবাড়ির ফেসবুকে অর্ডার দিয়েও সংগ্রহ করা যাবে।
তৃতীয় অশ্বারোহী থেকে পাঁচ কবিতা
নার্সিসিস্ট
সমান্তরালে হেঁটে যাওয়া ভালো, দূরত্ব বাড়ে না। আরও ভালো অন্তরালে হাঁটা। আমাদের সমস্ত কথাবার্তা শেষপর্যন্ত প্রেমের দিকে হেঁটে যায়, অন্তরালে। তুমি বেলি পছন্দ করো—সেখান থেকে ফুলের আলাপ প্রেমে গড়ায়। উৎপল থেকে, অবরোধ থেকে, ভূমিকম্প থেকে, পরশুর প্রজাপতি-উৎসব থেকে সমস্ত প্রজাপতি ও প্রসঙ্গ তোমার পালিত খরগোশের ভঙ্গিতে নিঃশব্দে প্রেমের দিকে যায়।
...ছ মাস পরে মৃত্যুর দিন বেঁধে দিয়েছে ডাক্তার। তার অভিমুখও বুঝি ঠিক ঠিক প্রেম বেছে নেবে?
তুমুল বৃষ্টি হলো, আজ মধ্যরাত—
ভেবেছিলাম আমার মৃত্যুতে।
আসলে সে বাড়িয়েছে লালায়িত জিভ
শিরিন নামের এক মহিলাকে ছুঁতে
প্রণামের ছলে যাকে ছুঁতাম, সে জিজ্ঞেস করেছিল, এই এক ছুঁতোয় পা ছুঁয়ে আর কতদিন! আরেকজন বলেছিল নার্সিসিস্ট। এক অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টির রাতে বলেছিল, নিজের জিভ নিজের শরীরের সর্বত্র যায় না দেখে আমি তার শরীরে বোলাই
নস্টালজিয়া
কোনো এক সূর্যাস্তকালীন অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজলির চমক দেখে এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আকাশও ধাতব। সম্ভবত আরেক ধাতুর আঘাতে ঝন ঝন করে বেজে উঠবে সে, আমার মতন। তেমন হলে খুব ভালো জাতের কোনো বাদ্যযন্ত্র বানানো সম্ভব—ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ধারণা করি, ওখানে ওয়েল্ডিং মেশিনে কেউ একজন চিড় ধরা আকাশ ঝালাই করছে; হয়ত তারই নাম মিকাইল এবং সে নিজে কখনো বৃষ্টিতে ভেজার অনুমতি পায়নি।
তার চোখও কি ওয়েল্ডিং মেশিন থেকে ছিটকে আসা উজ্জ্বল ফুলকির ঝাঁঝেই অশ্রুসিক্ত হয়, এমন সব সূর্যাস্তে?
শিরিন, আমার পুরনো জীবনের কথা খুব মনে পড়ে
প্রবল এক দুপুরে কেমিস্ট্রি স্যারের মেয়ে গ্লাসভর্তি লেবুর শরবত দিয়েছিল। সে লেবুর গাছটিকে দীর্ঘদিন আদর করেছি।
...এখনো শরীরজুড়ে বিঁধে আছে সবুজাভ কাঁটা
চিড়িয়াখানায় পেস্তা বাদামের শক্ত গুঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে দুর্বোধ্য রোগা জেব্রা। প্রান্তরের রক্ত বহন করা এসব জেব্রাদের আমি তুমুল অপছন্দ করি। তারা আমাকে টেনে নিয়ে যায় সাদাকালো সিনেমার যুগে; অন্ধকার, সিনেমা হলের গমগম শব্দ—হৃদয়েরও পাশে বসে মিহি শব্দে বাদাম ভাঙছ তুমি।
জেব্রা দেখলে সেসব স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাই এখনও...
চিড়িয়াখানায় জেব্রাদের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে থাকে পেস্তা বাদামের শুষ্ক পাতার উপর...তাদের পায়ের তলে ভেঙে যায় এতদিনকার সতেজ হাড়গোড়
গৃহস্থ
...রৌরব, প্রতিবিম্ব, অজ্ঞাত ও আমি তাস খেলি।
দিগ্বিদিক স্থির রেখে, স্টেথোস্কোপ অন্ধ করে দিয়ে
তোমার নিজস্ব স্তন হেঁটে যাক গৃহস্থ কাঁপিয়ে
আর গৃহে এসে বিভ্রান্তিকর এবং লাবণ্যময় মিহি আলোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পনির কাটতে বসো। কোটি কোটি জীবন্ত প্রজাপতি তখন উড়ে বেড়ায়
চেনা মফস্বলে
অলৌকিক
আমাদের মফস্বলে এই মোহনীয় বিকেলের রঙ নীল। গোপনে শুকাতে দেওয়া তোমার ও কামিজের রঙ এ-সময় ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ঢেকে দেয় সমস্ত হলুদ আভা। একটু পরেই সাইকেলের ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে পড়ব আমি, আর অদূরের ডাহুকী তার মুখস্থ ডাক ডাকতে শুরু করবে।
এসময় ছায়া তার শরীরের চেয়ে এতটাই দীর্ঘতর হয়ে উঠতে থাকে যে কেউ কেউ মাগরিবের অজু করতে দীঘির ঘাটে নেমে যাবে। কথিত আছে : কোনো একদিন সন্ধ্যার ঠিক পূর্ববর্তী সময়ে দীঘির দক্ষিণ দিক থেকে উঠে আসবে সাতশ বছরের পুরাতন গম্বুজ
—এখনো কেউ কেউ সেসব অলৌকিকত্ব বিশ্বাস করে বসে থাকে।
...জানি, সামান্য আড়াল পেলে উঠে আসবে তুমি,
গাঢ় সবুজ পদ্মপাতা সরিয়ে
এই নীল বিষণ্ন
বিকেলে
পিউ কাহাঁ
অতঃপর মধ্যরাতে রক্ত নয়, আমাদের শিরা
সংবহন করে এক নিরাসক্ত গোপন মদিরা;
সামান্য আড়াল পেলে আর সারাদিন
শিরা বেয়ে দৌড়ায় প্রতিটি শিরিন
সামান্য আড়ালেও হৃদয় হিরের দ্যুতি চায়। আর তুমি এসে দাঁড়াও সামনের বাগানে—পদ্মপাতার আচ্ছাদন সরিয়ে—হাতভর্তি শুকনো কাদা, নির্বাক চুলে আলগা পাপড়ি।
তোমায় পান করেই কি এতটা মাধুর্য তারা পেল?
আরক্তিম ঐ ফুলসমূহের আগেই কি তুমি ফুটে উঠছ—বিপন্ন ডালিমরূপে
কিন্তু আমরা জানি, সব ফুলই সুন্দর, তার আচ্ছন্ন ফলের চেয়ে।
...একটি ফলভূক পাখির কণ্ঠে নিকটবর্তী কোথাও বেজে ওঠে গজল, ‘পিউ কাহাঁ পিউ কাহাঁ—’
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৭
এসএনএস