ঢাকা: বিএনপির বি টিম তৈরি করে ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’র ব্যানারে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে মাঠে নেমেছেন শওকত মাহমুদ ও ফরহাদ মজহার- এমন অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ।
এরইমধ্যে বিএনপির ভেতরেই শঙ্কা জেগেছে, শওকত মাহমুদের পর কে বহিষ্কার হবেন?
এমন শঙ্কার কারণ জানালেন নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তারা (জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি) ২১৬ জন প্রার্থী বাছাই করেছেন। আর এ পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহের তালিকায় ৪২ জনের নাম লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে গেছে। এতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আলোচনা হচ্ছে শওকত মাহমুদের পরে কে বহিষ্কার হবেন?
সূত্র জানায়, মূলত যারা তরুণ, এলাকায় জনপ্রিয় অথচ বিগত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি তাদেরকে টার্গেট করে আগামী নির্বাচনে এমপি বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলাকায় কাজ করার জন্য গ্রিন সিগনাল দেওয়া হয়েছে। এ সিগনালের কারণেই বিএনপির অনেক স্থানীয় জনপ্রিয় নেতা দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকেন।
এ তালিকাও বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে আছে বলে দাবি করছেন দলটির নেতারা।
এদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ১/১১ থেকে শিক্ষা নিয়ে সংস্কারপন্থীদের ঠাঁই দিতে চায় না বিএনপি। এবারও সরকার থেকে বিএনপির একটি বলয়কে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নীল নকশা করবে- এটি মাথায় রেখেই সন্দেহভাজনদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, দলের ভেতর ১/১১- এর মতো পরিবেশ দেখতে চান না তারা। এর আগেই চিহ্নিতদের শেকড় উপড়ে ফেলতে নির্বাচনের আগেই কঠিন সিদ্ধান্তে যাবে বিএনপি।
তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের বেশ কিছু নেতাকে আগে থেকেই নজরদারিতে রেখেছে বিএনপি।
উল্লেখ্য, গত ১৬ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ নামে নাগরিক অধিকারবিষয়ক একটি সংগঠনের আহ্বায়ক কবি ফরহাদ মজহার, সদস্য-সচিব শওকত মাহমুদ বিএনপি ও সমমনা বিভিন্ন দলের নেতাদের নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করে সেই সরকারকে বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সম্বলিত একটি ঘোষণা পাঠ করা হয়।
সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণ-অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, লেবার পার্টির ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মজিদ, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইউসুফ হায়দার চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলী ও সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী, হাসান হাফিজ, ইলিয়াস খান, দিগন্ত মিডিয়ার চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদ প্রমুখ।
ওই অনুষ্ঠানের ৫ দিন পর গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে (ভার্চ্যুয়াল) ইনসাফ এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়। তাতে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জোরালো মত দেন সদস্যরা।
বিএনপি নেতাদের ধারণা, বিএনপিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশনেই ইনসাফ পরিচালিত হচ্ছে। ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র মতে, ওইদিন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও দলের বঞ্চিত নেতাদের অনেকেই অংশগ্রহণের কথা ছিল। তবে দলের তরফ থেকে তাদেরকে ওই অনুষ্ঠানে যোগদান না করতে অনুরোধ জানানো হয়। তাদের প্রতিও নজর রাখছে বিএনপি।
তাই শওকত মাহমুদকে বহিষ্কারের পর অনেকের মধ্যেই শঙ্কা কাজ করছে।
তবে, সংগঠনের স্বার্থে ও দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে বিএনপির হাইকমান্ড। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য এ বিষয়ে কৌশলী হচ্ছে দলটি।
সূত্রমতে, বৈঠকে সন্দেহের তালিকায় আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উঠলেও এখনই বহিষ্কার না করার বিষয়ে মতামত দেন স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য।
এদিকে ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ কোনো রাজনৈতিক দল নয় বলে দাবি করেছেন বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ।
বহিষ্কারের বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এটি একটি সামাজিক সংগঠন। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমার মতো চুনোপুঁটি দিয়ে সরকার বিএনপি ভাঙতে যাবে কেনো, কত রাঘববোয়াল আছে। মূলত অনেক সিনিয়র নেতা উল্টোপাল্টা করতে পারে। আমাকে বহিষ্কার করে তাদের থ্রেট দেওয়া হয়েছে।
শওকত মাহমুদ অবশ্য আগে থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়েন।
২০২২ সালের ২৭ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ‘পেশাজীবী সমাজের’ ব্যানারে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সমাবেশে শওকত মাহমুদসহ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। যেখানে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীও ছিলেন।
পরেতে গত ৬ এপ্রিল দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পেশাজীবীদের ব্যানারে ওই সমাবেশ করায় শওকত মাহমুদের কাছে ব্যাখ্যা চায় বিএনপি। সেই ব্যাখ্যার জবাব দিলেও তাকে দল থেকে আর কিছু জানানো হয়নি বলে জানান শওকত মাহমুদ।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সামনের বিক্ষোভে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানানো হয়। এর পরের বছরের ১৩ ডিসেম্বর ‘সরকারের পতনের’ লক্ষ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও জমায়েত করা হয়। যদিও বিএনপি থেকে এ কর্মসূচি দেওয়া ছিল না। তাই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ওই সময়েও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ, শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
শওকত মাহমুদের বহিষ্কারের বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরা দলীয় কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না, এটা পরিষ্কার। এখানে ইনসাফ বা বেইনসাফ কে কি করলো তাতে বিএনপির কিছু আসে যায় না।
তিনি বলেন, আগেও বিএনপির আকাশ থেকে অনেক বড় বড় তারকা চলে গেছেন, বিএনপির ক্ষতি হয়নি। বরং যারা চলে গেছেন, তারাই হারিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৩
এমএইচ/এসএএইচ