ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

‘নুরের তৎপরতা দলীয় গঠনতন্ত্র ও মূলনীতির পরিপন্থী’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০২৩
‘নুরের তৎপরতা দলীয় গঠনতন্ত্র ও মূলনীতির পরিপন্থী’ ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: গত ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের সব তৎপরতা দলীয় গঠনতন্ত্র ও মূলনীতির পরিপন্থী বলে অভিযোগ করেছেন দলের আরেকাংশের নেতারা।

বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ হলে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন দলের একাংশের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার অনুসারীরা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেন, গত ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে নুরুল হক নুরের সব তৎপরতা দলীয় গঠনতন্ত্র ও মূলনীতির পরিপন্থী। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ড. রেজা কিবরিয়ার কথিত অপসারণ সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ অপসারণ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি না এবং তিনি দলের আহ্বায়ক হিসেবে বহাল আছেন বলে মনে করি। সেই সঙ্গে আমরা ঘোষণা করতে চাই, ড. রেজা কিবরিয়াকে বাদ দিয়ে যারা কাউন্সিলের দিন নির্ধারণ করেছেন তারা পরিকল্পিতভাবে দলকে ভাঙনের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন।

চলমান পরিস্থিতিতে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের অভ্যন্তরে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের চর্চা ব্যাহত হয়েছে, যা এ দলের প্রতি মানুষের অপরিসীম প্রত্যাশাকে ক্ষুণ্ন করেছে।  

ফারুক হাসান বলেন, গত ১৮ জুন দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ড. রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নুর দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে ইনসাফ কায়েম কমিটির একটি সভায় অংশ নেওয়া ও তাদের কাছ থেকে অর্থগ্রহণের অভিযোগ তোলেন। এর জবাবে ড. রেজা কিবরিয়া ইনসাফ বাস্তবায়ন কমিটির সভায় যাওয়ার ব্যাখ্যা দেন। তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করেন এবং প্রমাণ থাকলে তা হাজির করতে বলেন। একই সময়ে তিনি নুরের বিরুদ্ধে কয়েকটি সুস্পষ্ট অভিযোগ আনেন। যার মধ্যে ইসরায়েলি নাগরিক ও কথিত মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে আলোচিত বৈঠকের সত্যতা সংক্রান্ত কিছু তথ্য, আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে দলীয় তহবিল নিজে গ্রহণ ও হিসাব না দেওয়া এবং শিপন বসুসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহভাজন লোকদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ তোলেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নুর কাতারে ইসরায়েলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে কোনো রকম আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে অস্বীকার করেন। বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও এ বৈঠকের আলোচ্যসূচি কী ছিল, তা তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অবগত করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় নুর দলের বয়োবৃদ্ধ কয়েকজন সদস্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক ও অশালীন ভাষায় কথা বললে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় ড. রেজা কিবরিয়া সভাস্থল ত্যাগ করেন এবং সভা মুলতবি করা হয়।

তিনি বলেন, ওই রাতেই দলের আহ্বায়ক একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান যে, তিনি জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং দেশে ফিরে পুনরায় সভা ডেকে এ বিষয়ে সমাধান করবেন। কিন্তু গত ১৯ জুন নুর দপ্তর সমন্বয়কের মাধ্যমে নোটিশ দিয়ে আরেকটি সভা ডাকেন, যা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বৈধ নয়। ওই সভায় নুর নিজেই সভাপতিত্ব করেন এবং সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্যে তিনি আবারও মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে এ বিষয়ে তিনি সদস্যদের আলোচনার সুযোগ না দিয়ে আহ্বায়কের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো উত্থাপন করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব তোলেন।

এ সময় অনেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি যেহেতু আহ্বায়ক কয়েকদিনের জন্য বিদেশে আছেন, তার অবর্তমানে দলের ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক চলতি দায়িত্ব পালন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারেন বলে মত দেন। কিন্তু সভা শেষে দপ্তর সমন্বয়কের স্বাক্ষরে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, ‘রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সরিয়ে রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক’ করার কথা। এমন বিজ্ঞপ্তি সুস্পষ্টভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রতারণামূলকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।

ফারুক হাসান বলেন, পরদিন আহ্বায়ক প্রবাসে অবস্থানরত অবস্থায় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গত ১৯ জুন অসাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আহ্বায়ককে অব্যাহতির নোটিশ দেওয়ায় তার নির্বাহী ক্ষমতাবলে নুর ও রাশেদ খানকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। একই দিনে দলের ৪৫ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উভয়ের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত করা প্রয়োজন দাবি করেন এবং পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটির সুপারিশ করেন।  

তিনি বলেন, গত ২১ জুন নুর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আরেকটি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত সবাই সমঝোতার জন্য অনুরোধ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনকে আহ্বায়কের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২২ জুন ওই ব্যক্তিরা আহ্বায়কের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, ২৬ জুন দেশে ফিরে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু এ তিনটি দিন অপেক্ষা না করে ২৩ জুন নুর আবারও দপ্তর সমন্বয়কে দিয়ে সভা ডাকেন। ওই সভায় নুর আহ্বায়কে অপসারণের প্রক্রিয়া নিয়ে সদস্যদের কাছে মতামত আহ্বান করেন। অধিকাংশ সদস্য এ সময় দলের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করার অনুরোধ করেন। পরে সভা শেষে নুর গণমাধ্যমকে বলেন যে, ৮৭ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহ্বায়ককে অপসারণ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।

এরপর ২৫ জুন ড. রেজা কিবরিয়ার কাছে শাকিল উজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ পাঠানো হয়, যাতে ৮৪ জনের স্বাক্ষর যুক্ত করা হয়। আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, ওই তালিকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বাক্ষর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের যথাযথ অনুমোদন না নিয়েই সংযুক্ত করা হয়েছে। নোটিশে আহ্বায়ককে সাত দিনের মধ্যে জরুরি সভা ডাকার আহ্বান করা হয়। ওই নোটিশে সাড়া দিয়ে ২৮ জুন আহ্বায়ক বার্তা দেন যে, ১ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি সভা হবে এবং সেখানে ওই প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কিন্তু ১ জুলাই জরুরি সভার ঠিক আগের রাতে নুর একই দিনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আরও তিনটি প্রোগ্রাম আহ্বান করেন। ফলে একটি থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ১ জুলাই সকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতি ছিল। এ সংবাদ পেয়ে নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করে ড. রেজা কিবরিয়া ওই সভায় উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভা পরিচালনা করার আহ্বান জানান। ফলে সভা যথারীতি শুরু হয় এবং সভায় ৪০-৪৫ জন সদস্য উপস্থিত হয়। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্রের ৩৮ ধারা অনুযায়ী আহ্বায়কের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস ও অপসারণ করতে হলে কেন্দ্রীয় কমিটির মোট সদস্যের দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১২১ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৮১ জন সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হয়। কাজেই মাত্র ৪৫ জন সদস্য উপস্থিতি বিশিষ্ট সভায় আহ্বায়ককে অপসারণ অসম্ভব। কিন্তু ওই সভায় সদস্যরা গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণের আহ্বান জানালে তা না করে প্রকাশ্যে হাত তুলে সমর্থন জানাতে বলা হয়। ফলে অনেকেই ভোটদানে বিরত থাকেন। কিন্তু সভা শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে রেজা কিবরিয়াকে দুই তৃতীয়াংশের ভোটে অপসারণ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, যা সম্পূর্ণ অগঠনতান্ত্রিক ও প্রতারণামূলক।

ফারুক হাসান বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কাজ চালিয়ে যাব। তারই অংশ হিসেবে আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে সুনির্দিষ্ট দাবি পেশ করছি।

দাবিগুলো হলো-
১. অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না।

২. অবিলম্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।

৩. বাংলাদেশের পাসপোর্টে আগের মতো অ্যাকসেন্ট ইসরায়েল (Except Israel) লেখাটি পুনর্বহাল করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গোপন কোনো সম্পর্ক থাকলে তা তদন্ত করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- গণঅধিকার পরিষদের একাংশের যুগ্ম আহ্বায়ক সাদ্দাম হোসেন, কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান, জাকারিয়া পলাশ, মুফতি সোহাইবি, আবুল কালম আজাদ প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২৩
এসসি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।