চাঁদপুর থেকে: জাতীয় সম্মেলনের আগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন করার নির্দেশ থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি চাঁদপুর আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউই। আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলন হলেও এখন পর্যন্ত উপজেলাগুলোর সম্মেলন হয়নি।
আগামী ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এর আগেই ১৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির। জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে গত ২৭ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কাউন্সিল অধিবেশন ছাড়াই নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়া হয়নি।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই চাঁদপুর আওয়ামী লীগের মধ্যে চলে আসছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এ সম্মেলনেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে জানা গেছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই দীর্ঘ ১১ বছর সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন পর এই সম্মেলনে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘোষণার পরপর সম্মেলন স্থলেই শুরু হয় দুই গ্রুপের চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি। শেষ পর্যন্ত পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এ সম্মেলনে সভাপতি পদের জন্য অনেকদিন আগ থেকেই লবিং চালিয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির বড় ভাই ডাঃ জে আর ওয়াদুদ টিপু। অভিযোগ রয়েছে, তিনি সভাপতি হতে না পারায় তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোন্দলের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ আছে।
এর আগে বিভিন্ন সময় সাংগঠনিক কর্মসূচিতেও দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেখা গেছে। অনেক সময় জেলা আওয়ামী লীগের ব্যনারে কোন কর্মসূচি দেয়া হলে, তার বিপরীতে একই ধরনের কর্মসূচি দিতে দেখা গেছে চাঁদপুর সদরের এমপি ডাঃ দীপু মনির সমর্থকদের। এসব কর্মসূচিতে ব্যানারে দীপু মনির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ডাঃ দীপু মনি কোন কোন দলীয় কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকলে, ওই একই অনুষ্ঠানে জেলা সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভুঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালকে বিশেষ অতিথি করা সত্ত্বেও তারা উপস্থিত থাকতেন না। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে দলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ।
নতুন কমিটি দেয়ার পর আগামীতে এই পরিস্থিতির কতটুকু অবসান ঘটবে তা নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে।
এই কোন্দলের কারণেই এখন পর্যন্ত জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। পাশাপাশি গত ১৫/১৬ দিন আগে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সভাপতি শামছুল হক ভুঁইয়ার নির্বাচনী এলাকা ফরিদগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রার্থী নির্ধারণের জন্য ডাকা বর্ধিত সভা পণ্ড হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সভায় ডাঃ দীপু মনির নিকট আত্মীয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম রোমানের সমর্থকরা হামলা চালায়। ওই সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল খায়ের পাটওয়ারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন।
এদিকে জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে উপজেলা সম্মেলনগুলো সম্পন্ন করার জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে দীর্ঘদিন আগেই। কিন্তু চাঁদপুরের ৮ উপজেলার একটিতেও সম্মেলন হয়নি। প্রায় ১০/১১ বছর ধরে উপজেলাগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে। জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগহীনতার কারণেই এ সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি বলে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ। সম্মেলনের ব্যাপারে চাঁদপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল ইসলাম নাজিম দেওয়ানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর পূর্বে আমাদের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে। আমরা গত ১ বছর ধরে সম্মেলন করার জন্য জেলার অনুমতি চেয়েছি। ৩/৪বার চিঠি দিয়েও জানিয়েছি। কিন্তু জেলা অনুমতি না দেয়ায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। জেলা থেকে অনুমতি পেলে আমরা সম্মেলন করবো।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বললেন অন্য কথা।
তিনি বলেন, অনেকগুলো উপজেলার সম্মেলন হয়েছে। ২/৩টির সম্মেলন বাকী রয়েছে। এগুলোর কমিটি ভেঙ্গে দিতে পারি, যেহেতু জেলার সম্মেলন হয়েছে। জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে নাগাদ দেয়া হবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সম্মেলন হয়েছে, নিশ্চয়ই কমিটি দেয়া হবে। কমিটি দেবে কেন্দ্র।
এদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই জেলা বিএনপির কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। সর্বশেষ জেলার সম্মেলন হয়েছে ২০১০ সালে। দলীয় কর্মসূচিও সীমিত আকারে পালন করা হয়, তাও দিবস ভিত্তিক। বছর খানেক আগে জেলা কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে। আহবায়ক শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক চাঁদপুরে থাকেন না বললেই চলে। তিনি মাঝে মধ্যে কর্মসূচি উপলক্ষ্যে চাঁদপুরে আসনে, কর্মসূচি শেষ করে আবার চলে যান। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীর সঙ্গে তার সাংগঠনিক যোগাযোগ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেলা বিএনপির বর্তমান আহবায়ক শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক নিজের অনুসারীদের কাছে নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। বিএনপি’র সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, বিশেষ করে যারা দলের জন্য নিবেদিত তারা তার কাছে ভিড়তে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে চাঁদপুর সদরের সাবেক দুইবারের এমপি জিএম ফজলুল হক, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি রাশেদা বেগম হীরা, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান ভুঁইয়া বর্তমানে দল থেকে দূরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের সঙ্গে বর্তমান আহবায়কের দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব রয়েছে। জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার পর উপজেলাগুলোতেও এ দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। সাবেক জেলা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের নির্বাচনী এলাকা শাহরাস্তি এবং হাজীগঞ্জ উপজেলা পূর্বের কমিটি ভেঙে নতুন আহবায়ক কমিটি দিয়েছেন বর্তমান আহবায়ক শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক। কিন্তু পূর্বের কমিটি এখনো আলাদা ব্যানারে কর্মসূচি পালন করে।
এদিকে ৮ উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার সম্মেলন হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি কচুয়া, ফরিদগঞ্জ ও হাইমচর উপজেলায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে সম্মেলনের কথা বলা হলেও বাস্তবে বর্ধিত সভা করে কমিটি ঘোষণা দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক দেওয়ান মো. সফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক নেতা-কর্মীর নামে মামলা আছে। ভয়ভীতি আছে বলে সাংগঠনিক কার্যক্রমে যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তারপরও আমি বলবো সারাদেশে বিএনপির কর্মকাণ্ডের চেয়ে চাঁদপুরে কর্মকাণ্ড অনেক বেশী হয়।
জেলা সম্মেলন সম্পর্কে জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক অ্যাড. সলিম উল্যাহ সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে কেন্দ্র থেকে সম্মেলনের কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্র্দেশ দিয়েছে। তাই জেলার সম্মেলন ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করা সম্ভব হয়নি। ৩টি উপজেলা সম্মেলন বাকী রয়েছে। এগুলো আমরা দ্রুত করে ফেলবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৩১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৬
এসকে/জেডএম