ঢাকা: একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযুদ্ধ কখনও গল্প না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযুদ্ধ কড়কড়ে সত্য।
মুক্তিযুদ্ধে কিছু কবি-সাহিত্যিকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো। রফিক আজাদ লিখেছেন, প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন। তিনি রণাঙ্গনের কবি।
ষাটের দশকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি রফিক আজাদ শনিবার (১২ মার্চ) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে যান না ফেরার দেশে।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে স্মৃতিচারণ করেন।
কবি হিসেবে রফিক আজাদকে মুক্তিযুদ্ধের দশ-বার বছর আগে থেকেই চিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর পায়ে অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম তখন রফিক আজাদও ছিলেন।
বাংলাদেশে অনেক কবি আছে। আমি মনে করি, রফিক আজাদ মুক্তিযুদ্ধের কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি।
আমার মনে হয় না দেশের আর কোনো কবি-সাহিত্যিক কামানের গোলার গর্জন শুনে অথবা মেশিন গানের গুলির শব্দ শোনার পরও লিখতে পেরেছেন। আমরা বন্দুক চালিয়েছি আর উনারা নিরাপদে কলম চালিয়েছিলেন। কিন্তু উনাদের কানে উভয়পক্ষের গুলির শব্দ গেছে।
বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক হাতে লিখে কাদেরিয়া বাহিনীর ‘রণাঙ্গন’ পত্রিকা বের করেছিলেন। তাদের মধ্যেও অন্যতম রফিক আজাদ। আর তখন কাদেরিয়া বাহিনী একমাত্র দল যারা একেবারে দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে সফলতা এনেছে।
রণাঙ্গন পত্রিকাই ছিলো একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রের পত্রিকা। সে সময় রণাঙ্গনের সঙ্গে কাজ করেছেন কবি মাহবুব সাদিক, বুলবুল খান মাহবুব, কবি কায়সার, সাজ্জাদ কাদির। কেউ কেউ চলে গেছেন, রফিক আজাদ গেলেন, বাকিরা ক’দিন পর একে একে যাবেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজে অধ্যাপনা করতেন কবি রফিক আজাদ। তখন থেকেই তিনি আগাগোড়া একজন বিপ্লবী মানুষ। তিনি যাকে বিয়ে করেছিলেন, তার বড় ভাই আনোয়ারুল আলম শহীদ আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো।
এক সময় রফিক আজাদের শ্বশুর রহিম মৌলভী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগ করতেন। তার ছেলে আনোয়ারুল আলম শহীদ ছাত্রলীগ করতেন। সে সময় সমাজের প্রভাবশালীদের শান্তি কমিটির সদস্য বানানো হয়েছিলো। রহিম মৌলভীকেও শান্তি কমিটির সদস্য করা হয়েছিলো। শান্তি কমিটির সবাই যে পাকিস্তান চাইতো- বিষয়টা কিন্তু সেরকম না।
একাত্তরে আনোয়ারুল আলম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় তাকে ফিরিয়ে নিতে জুলাইয়ের শেষের দিকে বা আগস্টের শুরুর দিকে, সুখীপুরের গহীন জঙ্গলে- যেখানে আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিলো সেখানে রফিক আজাদকে পাঠিয়ে ছিলেন রহিম মৌলভী সাহেব। সেখানে গিয়ে আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে তিনি নিজেই যুক্ত হয়ে পরেন। সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত অনুভূতি দিয়ে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
তেয়াত্তরে দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিল তখন ‘ভাত দে হারামজাদা’ বলে একটি কবিতা লিখে সাঘাতিক আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। তখন আমি ছাত্রলীগের নেতা, সারাজেলা দাঁপিয়ে বেড়াই।
সেসময় আইন ছিলো এ রকম যে, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলে ছয় বছরের জেল হবে। আপিল করা যাবে না। আমাদের তো শত্রুর অভাব ছিলো না।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদের জন্ম হলো। তখন সমালোচনা করলেই বলা হতো রাষ্ট্রদ্রোহীতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অন্যরকম মানুষ ছিলেন। তার সময়ে কোনো যোগ্য মানুষ অপমানিত হননি।
কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর রফিক আজাদের নামে মামলা হয়ে গেলো। জেল তো অবধারিত। তখন আমি নিজেও খুব বিক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন তিনি আমার এই বাসায় এলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি আমাকে স্যার বলে ডাকতেন। যদিও রফিক আজাদ কমপক্ষে আমার থেকে তিন বছরের বড় হবেন। এসেই বললেন, স্যার আমাকে বাঁচান, আমার তো জেল হয়ে গেছে।
তখন তো আমিও তেমন জানি না, তো আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি এমন কথাটা লিখলেন, বঙ্গবন্ধুকে হারামজাদা বললেন! এটা কি করলেন আপনি!
রফিক আজাদ উত্তর দিলেন, স্যার আমি বঙ্গবন্ধুকে কোথায় হারামজাদা বললাম! আমি তো বলছি বাবাকে। এরপর আমাকে বুঝিয়ে দিলেন।
স্যার বলেন তো ক্ষুধা পেলে সন্তান মাকে কি বলে? হ্যাঁ, আমিও ভাবলাম ঠিকই তো, ক্ষুধা লাগলে ছেলে মাকে বলে ‘এই মা ভাত দে’। ক্ষুধা লাগলে তো বাবাকে ভাত দে কইতেই পারে।
এই ব্যাখ্যা শোনার পরই আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম, শুনতেসি আপনি নাকি রফিক আজাদরে জেল দিতেসেন?
বঙ্গবন্ধু বললেন, দেখতো এরকম একটা কবিতা! ওর কি অভিযোগ যে এরকম গালাগালি করতাসে। তখন বললাম, ওতো আপনাকে গালাগালি করে নাই। ও আপনাকে সচেতন করেছে। ওতো ভালো বলেছে। আমি আরও কিছু ব্যাখ্যা করলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখনই রফিক আজাদকে নিয়ে আসতে বললেন বঙ্গবন্ধু। বললাম, এখন তো পাবো না, কাল নিয়ে আসি?
বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে কাল নিয়ে আসিস। আমি ওর কবিতা শুনবো। পরদিন নিয়ে যাওয়ার পর চার-পাঁচবার কবিতাটা রফিক আজাদকে দিয়ে পড়িয়েছিলেন। কবিতা শোনার পর রফিক আজাদের পিঠ চাপড়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই ঠিক বলেছিস। আরও কবিতা লিখবি তুই।
তখন রফিক আজাদ বললেন, আমাকে জেলে নিয়ে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন কবিতা লিখেতে! তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, তোকে কে জেলে নেবে? তোকে জেলে নেওয়ার আগে আমাকে নেবে। তুই ঠিক লিখেছিস। তুই আমার কাছে আসবি।
অনেক মানুষ ভুল বোঝায়, তোর লেখার মতো লেখাই তো আমি চাই। সাথে সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিকে ডেকে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বললেন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে আমাদের নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই লোকজনের। মুক্তিযুদ্ধে যারা অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে তাদের নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। কবি রফিক আজাদের বেলায়ও সেটা দেখে এলাম।
রফিক আজাদকে আগে যেমন দেখেছি, আজও তেমনই দেখলাম। ভীষণ কষ্ট লেগেছে। তার মুক্তিযুদ্ধের কোনো সার্টিফিকেট নেই। কাল অথবা পরশু তাকে যখন মিরপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে- মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের জন্য নির্ধারিত জায়গা তিনি পাবেন কিনা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাবেন কিনা এ নিয়ে তার পরিবারের যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
দুই-তিন মাস ধরে তিনি হাসপাতালে, কোথায়! রাষ্ট্রতো তার দিকে ফিরেও তাকায়নি, রাজনীতি তার দিকে ফিরে তাকায়নি। কত মিছিল-সমাবেশ হয়, কোনো নেতাকে তো দেখলাম না তার পরিবারকে সান্তনা দিতে। এখন মানসিকতাইটাই যেন কেমন হয়ে গেছে...
মুক্তিযদ্ধের কবি, একজন মুক্তিযোদ্ধা উপযুক্ত সম্মান পেলো না।
বাংলাদেশ সময়: ২২০২ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
এটি/