মাদক আর দুর্নীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর বেহাল দশাকে ফরিদগঞ্জের দুঃখ হিসেবে চিহ্নিত করেন সাংবাদিক শফিকুর রহমান। তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে তার ভাবনার কথাও জানান তিনি।
শপথ গ্রহণ শেষে বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ফরিদগঞ্জের উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন শফিকুর রহমান।
সাংবাদিক সমাজে সজ্জন হিসেবে পরিচিত শফিকুর রহমান বলেন, ‘ফরিদগঞ্জের এক নম্বর সংকট-যেটাকে ফরিদগঞ্জের দুঃখ বলেছি সেটা হলো মাদকাসক্তি। মাদকের ব্যবসা, মাদকাসক্তি; এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতি এগুলোর বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ। ’
‘পুরো ফরিদগঞ্জ এখন মাদকের হাব হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে এই তিনটির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করবো। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি এবং এই যুদ্ধেও জিতবো ইনশাল্লাহ। ’
বরাদ্দ এলে জনসভা ডেকে প্রকাশ করবো
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা শফিকুর রহমান বলেন, আগের সংসদ সদস্য কিছু গুণ্ডাপাণ্ডা লালন পালন করতেন। সে সময় যত টাকা পয়সা এলাকার উন্নয়নের জন্য গেছে- কেউ বলতে পারবে না সেসব টাকা কোথায় গেছে? কি কাজে লেগেছে?
‘আমি নিজে ঘোষণা দিয়েছি যত সরকারি বরাদ্দ আসবে আমি জনসভা ডেকে সেটা প্রকাশ করবো এবং ওই এলাকার লোকজনকে ডেকে কাজ করবো। ’
তিনি বলেন, ‘যেটা আমি প্রেসক্লাবে করেছি। প্রেসক্লাবে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি। প্রত্যেক মাসে কত আয় হয়, ব্যয় হয় সব প্রকাশ করতে হয়। ’
সততার ওপর গুরুত্বারোপ করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘যে জিনিসটা দরকার, সেটা হলো আমাদের একটু সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে যেটা হয়, একজন সংসদ সদস্যের অর্থ আত্মসাতের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সে যা সুযোগ-সুবিধা পায় এতেই তার চলে যায় এবং ভালোভাবেই চলে যায়। ’
‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছেন সম্পদের প্রয়োজন নেই। সন্তানরাই আমার সম্পদ। আমিও সেটাই বিশ্বাস করি। ’
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি স্বচ্ছল একজন মানুষ। আমি যদি বলি আমার সম্পদ নেই, গুনাহ হবে। আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। একজন মানুষের চলার জন্য যা প্রয়োজন সবই আছে। আমার তো কোনো অভাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমার চাহিদা কম। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন আমি তাতেই খুশি। ’
জনগণ আর আমার মধ্যে কাউকে ঢুকতে দেবো না
সরকারি অর্থ আত্মসাতকারী, গুণ্ডাপাণ্ডা এবং সংসদ সদস্যের কাছের লোক ইত্যাদি সাইনবোর্ড ব্যবহারকারী প্রতারকদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সাংবাদিক শফিকুর রহমান বলেন, তাদের বলবো ‘ভালো হয়ে যান। ’
তিনি বলেন, ‘আমি জ্ঞানত কাউকে অ্যালাউ করবো না। সে আমার পরিবারেরই হোক, দলেরই হোক কিংবা কোনো মহান ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকেই হোক। আমি এগুলো অ্যালাউ করবো না। ’
‘আমি চেষ্টা করবো। জনগণ আর আমি এর বাইরে আমি আর কাউকে ঢুকতে দেবো না। ’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি জানি এতে অনেক শত্রু হবে। শত্রুর ভয় করলে তো রাজনীতি করা উচিত না, নির্বাচন করাও উচিত না। তাই না। ’
অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ উন্নত করা হবে
ফরিদগঞ্জের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক অত্যন্ত দুর্বল। যেমন পূর্বাঞ্চলের মানুষগুলোর ফরিদগঞ্জ প্রোপারে আসার ভালো রাস্তা নেই। এখন অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সড়কগুলো উন্নত করা হলে ফরিদগঞ্জের পূর্বপ্রান্তের মানুষকে ফরিদগঞ্জ শহরে আসতে হলে রামগঞ্জ, রায়পুর আর না হয় হাজীগঞ্জ-চাঁদপুর আসতে হবে না। ’
‘আমরা এই যোগাযোগ উন্নত না করলে একদিন হয়তো পূর্বাঞ্চলের মানুষ আওয়াজ তুলবে আমরা আর ফরিদগঞ্জের সঙ্গে থাকবো না। ’
তিনি বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলটা- শুধু বাঁধের বাইরে না, বাঁধের ভেতরেও একটি রাস্তা ভালো আছে? একটি রাস্তাও ভালো নেই। ’
উটতলী ব্রিজ নিয়ে হতাশা
মুন্সিরহাটের উটতলী খেয়াঘাটে উটতলী ব্রিজের জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ, ফরিদগঞ্জের পাশের বেইলি ব্রিজটা ৭১ কোটি টাকা দিয়ে কংক্রিট ব্রিজ করা, বেড়িবাঁধ সড়কের জন্য ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাসহ অতীতে সংসদ সদস্য না হয়েও এলাকা সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন সাংবাদিক শফিকুর রহমান।
যদিও মুন্সিরহাটের উটতলী খেয়াঘাটে ব্রিজটি না হয়ে ফরিদগঞ্জের মূলপাড়া এবং হাইমচরের কামরাঙা মধ্যে সংসদ সদস্য দীপু মণির বাবার নামে নির্মিত হয়। মূলপাড়া অংশে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন গত সংসদে ফরিদগঞ্জের সংসদ সদস্য শামসুল হক ভূঁইয়া, কামরাঙা অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন হাইমচরের সংসদ সদস্য দীপু মণি।
অন্যদিকে বেড়ি বাঁধের বরাদ্দ প্রক্রিয়াটি পরবর্তীতে স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজ এগিয়ে নিয়ে না যাওয়ায় থেমে যায় বলে অভিযোগ আছে এবং পরবর্তীতে সেই রাস্তার জন্য সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পায় বলে জানা গেছে।
উটতলী ব্রিজটি না হওয়ায় নতুন এমপি শফিকুর রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, `চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, রামগঞ্জ, রায়পুর, হাজীগঞ্জ পাঁচটা থানার কানেকটিভি নিশ্চিত করতো উটতলী ব্রিজটা। সেটাই আমি চেয়েছিলাম। অথচ এই ব্রিজ দিয়ে এখন শুধু কামরাঙার লোকজন তাদের শশুর বাড়ি মূলপাড়ায় আসবে আর মূলপাড়ার লোকজন তাদের মেয়ের বাড়ি যাবে। সামান্য কিছু লোক সুবিধা পাবে। '
তিনি বলেন, আমি ছাত্র জীবনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই স্কুলটি কিন্তু আমার নিজের নামে করিনি। অথচ একজন শুধু নিজের বাবার নামে ব্রিজ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে এখানে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়।
তরুণদের চাকরি নিয়ে ভাবনা
তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে নিজের আন্তরিকতার কথা জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, ‘অসম্ভব বড় দায়িত্ব। … যারা দিনরাত পাগলের মতো কাজ করে আমাকে এখানে বসার সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানে অনেক তরুণ আছে, সেই তরুণদের বিরাট অংশ আছে- যারা এখনও চাকরি পায়নি, বেকার আছে। ’
‘সেই তরুণদের কারো কারো রাজনীতি করার আকাঙ্ক্ষা আছে। কারো কারো আমলা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। এসব জিনিসগুলো যখন ভাবি, তখন দেখি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞ কতটুকু করতে পারবো জানি না। তবে একটা জায়গায় আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল আছে। ’
সাংবাদিক শফিক বলেন, `সবচেয়ে বড় কথা হলো একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভেতরের যে শক্তিটা; এটা অসম্ভব, মানে অপ্রতিরোধ্য শক্তি। একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনও ঘাবড়ায় না। আমি তো ঘাবড়ানোর প্রশ্নই উঠে না। যেহেতু আমার নেতা হচ্ছেন বিশ্বের সেরা নেত্রী, সেরা প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী, সৎ দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রনেতা। যিনি আমার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি যখন আছেন আমি কোনো দুঃশ্চিন্তাই করি না। ’
বিগত সময়ে সংসদ সদস্য না থেকেও তিন শতাধিকের বেশি ছেলে-মেয়েকে চাকরি দিয়েছেন জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, ‘কোনো সংসদ সদস্যও বলতে পারবে না- ৩০০ ছেলে-মেয়েকে চাকরি দিয়েছে। ’
আস্তে আস্তে সংসদ সদস্য হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছেটা জাগলো
সাংবাদিক শফিকুর রহমান বলেন, ‘১৯৭৩ সাল থেকে, বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে এই পার্লামেন্ট (সংবাদ) কভার করে আসছি। সেই আস্তে আস্তে কেন জানি আমার মন, একটা ইচ্ছে জাগলো গ্যালারি থেকে একটু জাম্প দিয়ে সদস্য হওয়ার; সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো। ’
‘সামাজিক কাজ করতে করতে মানুষের জন্য স্কুল-কলেজ করা, রাস্তাঘাট করা। শত শত ছেলে-মেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করা বা চাকরি পেতে সাহায্য করা। এগুলো আমি সারাজীবন করে এসেছি। করতে করতে আমার মনে হয়েছে একজন জনপ্রতিনিধি হলে এসব কাজ যত সহজে করা যায় সংসদ সদস্য নয় এমন একজন যত ক্ষমতাধরই হোক অত সহজে করা যায় না,’ যোগ করেন তিনি।
ছাত্র জীবনের সামাজিক কাজের কথা তুলে ধরে এই সাংবাদিক বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে আমি স্যোশাল ওয়ার্ক করতাম। পাকিস্তান আমলে আমি হাই স্কুল বানিয়েছি, ছাত্র জীবনে। যেটা কেউ কল্পনাও করে না। ’
‘একটা লোক ছাত্র, সে হাই স্কুল বানিয়ে ফেলেছে। গ্রামবাসীকে নিয়ে হাইস্কুল বানালাম। এই হাইস্কুল বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাইস্কুল বন্ধ করলাম। আমি হলাম অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক (অবৈতনিক),’ বলেন শফিকুর রহমান।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৯
এমইউএম/আরআর/এমএ