ঢাকা: ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে গোটা দেশ। স্থানভেদে দিন-রাতে ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অর্থ সংকট এবং বেশি দামে ব্যবসায়ী ও উচ্চ বিত্তের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্র তৈরির জন্যই এই লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
লোডশেডিংয়ে একদিকে ধনীরা আগ্রহী হবে। একই সঙ্গে পরে লোডশেডিং নিয়ে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে, সেজন্যও ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। কারণ ধনীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চালু হলে এই লোডশেডিং অব্যাহত থাকার আশংকার কথাও জানিয়েছেন তারা।
পিডিবি বলেছে, সরকার চাইলেই তারা এখন লোডশেডিং বন্ধ করতে পারবে। এ জন্য তাদের ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ওই সূত্রটি দাবি করেছে, চলতি অর্থ বছরে তাদের ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে লোকসান সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, পিডিবির অপরিপক্ক পরিকল্পনার কারণে ভয়াবহ রকমভাবে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা ছুতো খুঁজছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য।
সেচ মৌসুম শুরু হলে বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে নেয় পিডিবি। তখন পিডিবির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘দাম না বাড়ালে লোডশেডিং বাড়াতে হবে। কিন্তু দাম বাড়লেও সমান তালে বেড়েছে লোডশেডিং। ’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘পিডিবি উল্টো পথে হাঁটছে। তারা নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলে সেচ মৌসুমের আগে দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা নিরবচ্ছিন্ন লোডশেডিং দেখছি। ’
এখন বিশেষ শ্রেণীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার নামে বিদ্যুৎকে ধনী-গরীবে ভাগ করা হচ্ছে। এতে গরীবেরই কষ্ট বাড়বে। সেচে যেমন দাম বাড়ালেও তারা বাড়তি উৎপাদন করেনি। আমি আশংকা করছি, একইভাবে ধনীর জন্যও উৎপাদন বাড়বে না। গরীবের বিদ্যুতই তাদের ঘর আলোকিত করবে। ’
শামসুল আলম দাবি করেন, ‘আমরা আগে থেকেই বলে আসছি পিডিবি যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে শেষ রক্ষা হবে না। তাদের আরো বিকল্প ছিলো কিন্তু তারা সে পথে হাঁটছে না। আমরা কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করেছিলাম তারা শোনেনি। এখন ঠিকই বেকায়দায় পড়েছে। একইভাবে ধনীর জন্য নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে গেলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কারণে তখন ধনীদের বিদ্যুৎ দিতে না পারলে সরকারকে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
২৬ এপ্রিল ঢাকায় একটি হোটেলে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সরকারের হাতে ২’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ থাকার কথা স্বীকার করেন সাংবাদিকদের কাছে। এক প্রশ্নের জবাবে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সে সময় বলেছিলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য এখনই সরকারের হাতে ২’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রয়েছে।
সরকারের হাতে বিদ্যুৎ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে সম্প্রতি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) তমাল চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, ‘পিকিং ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশ কয়েকটি বন্ধ রয়েছে। এইসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সব সময় চালানো হয় না। সারাদিন চালালে বিদ্যুৎ আরো বেশি উৎপাদন হতো। কিন্তু তাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যেতো। এ কারণে চক্রাকারে এসব কেন্দ্র চালানো হয়। ’
সূত্র জানায়, পিডিবি এখনই বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে চায় না। সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি এই ২’ শ মেগাওয়াটের সঙ্গে আরো পাঁচ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করে তা ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্তের কাছে বিক্রি করবে। ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত মানুষ যাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পায়, তার জন্য এ চেষ্টা।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্তকে বেশি অর্থ দিতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন এ বিদ্যুতের নাম রাখা হয়েছে ‘কিউ’ শ্রেণীর বিদ্যুৎ। কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের জন্য এরই মধ্যে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) একটি গণশুনানিও করেছে। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিন আদেশ আসতে পারে।
প্রথম দফায় শিল্পে বেশি দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হবে, পর্যায়ক্রমে আবাসিক গ্রাহকদেরও এ শ্রেণীর বিদ্যুৎ দেওয়া হবে।
বেশি দামের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে পিডিবি।
কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের মূল্যহার সম্পর্কে বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমই) প্রেসিডেন্ট সেলিম ওসমান বলেন, ‘আমরা বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনবো না। ব্যবাসায়ীরা নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করবে। এর জন্য সরকারকে কম সুদে ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি শুল্ক ফ্রি জেনারেটর আমদানির সুযোগ দিতে হবে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য আমরা বেশি দামে কেন বিদ্যুৎ কিনবো? আমাদের সুযোগ দিলে আমরা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকার মধ্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবো। ’
ব্যবসায়ীদের মত, এতো বেশি দামে বিদ্যুৎ দিয়ে উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। এ কারণে তারা কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নয়।
সরকারের হাতে থাকা ২’শ মোগাওয়াটের পাশাপাশি বর্তমানে ৩১শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করা হচ্ছে। ৩১শ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে পিকিং ও রেন্টালের ১৭শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে পিডিবি।
রেন্টাল ও পিকিং কেন্দ্রগুলোর অন্তত ১৭ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণ হিসেবে পিডিবি বলছে, প্রতিদিন এ কেন্দ্রগুলো সচল রাখতে সরকারের ৫০ কোটি টাকার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। পিডিবির অব্যাহত লোকসানের কারণে বাধ্য হয়েই এ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, কিউ শ্রেণীর গ্রাহকদের জন্য আলাদা বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেছে পিডিবি। সে কারণে সাধারণ শ্রেণীর গ্রাহকদের লোডশেডিং বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
সেচের আগেও তো পিডিবি লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে নিয়েছিলো, কিন্তু ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের আদেশের দিনে আসুন, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১২
ইএস/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর