ঢাকা: বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার নামে ১ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে সরকার সমর্থক কোম্পানি হিসেবে পরিচিত সামিট গ্রুপের হাতে। এর ফলে ডে পিকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা চলে যাচ্ছে সামিটের হাতে।
এভাবে মাত্র এক কোম্পানির হাতে এতো অধিক বিদ্যুৎ বর্গা দেওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ খাতে চরম বিপর্যয়ের আশংকা করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা। সামিটের হাতে তুলে দেওয়া বিবিয়ানা ১ ও ২ এবং মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র যথাসময়ে শেষ হবে কি না তা নিয়েও সংশয় ধ্বণিত হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহলে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হিসেবে অনুযায়ী, দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট হলেও দিনপ্রতি উৎপাদন সাড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যেই ওঠানামা করে।
এর মধ্যে সামিট গ্রুপ ৫টি কেন্দ্র থেকে ৩১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ পেয়েছে। আরও তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে ১০১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে তাদের।
এর মানে হলো ১ হাজার ৩৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছে সামিট, যা বর্তমান সময়ে ডে পিকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক।
এমনকি এ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিশ্চিত করতে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, কেন্দ্র না চালালেও উচ্চ ক্যাপাসিটির বিল্ডিং চার্জ নির্ধারণ ও ভর্তুকি মূল্যে কেন্দ্রে তেল সরবরাহসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সরকারি দলের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর ভাইয়ের কোম্পানি সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন সামিট পাওয়ারের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৫ টি। এগুলো হলো- সামিট পাওয়ার ঢাকা, মদনগঞ্জ, জানজালিয়া, কুমিল্লা ও উল্লাপাড়া।
এ ছাড়া তাদের সঙ্গে আরও ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে। এগুলো হলো বিবিয়ান ১, বিবিয়ানা ২ ও মেঘনাঘাট।
কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পার হলেও বিবিয়ানা-১ ও ২ বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি নির্মাণে এখন পর্যন্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী আগামী বছরের আগস্টের মধ্যে ৬৮২ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র দুটি উৎপাদনে আসার কথা।
আর মেঘনাঘাটে ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার সামিটের অপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ শুরু হলেও অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় এ কেন্দ্রটির কাজও সময়মতো শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশিষ্টরা। অথচ এ সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করেই গলাবাজি করছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী।
মহাজোট সরকারের প্রথম দিকে তিনি ২০১২ সালে দেশে লোডশেডিং থাকবে না বলে দাবি করলেও এখন উল্টো সুরে গাইছেন।
নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলছেন, “গ্রাহক বেড়েছে, চাহিদা বেড়েছে- তাই লোডশেডিং দূর করা যাচ্ছে না। ”
এদিকে গত অর্থ বছরে বিদ্যুতে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকলেও জ্বালানি উপদেষ্টার ভ্রান্ত নীতির কারণে চলতি অর্থ বছরে বিদ্যুতে ভর্তুকি ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছে পিডিবি। যা ২০০৯-১০ অর্থ বছরে মাত্র ২৮৭ কোটি টাকা ছিলো।
পিডিবির হিসেবে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি গড় উৎপাদন ব্যয় ছিলো ২ দশমিক ৬২ টাকা। কিন্তু জ্বালানি উপদেষ্টার ভুল পরিকল্পনার বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাড়ে ছয় টাকার উপরে উঠে গেছে।
এই হিসেবে পুরো মাত্রায় রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো হলে এ দর ১২ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, “কুইক রেন্টাল পদ্ধতি কেবল যুদ্ধবিধস্ত দেশে ব্যবহার হয়ে থাকে। ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রথম এ পদ্ধতি ব্যবহার করে। কুইক রেন্টান দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ থেকে গুটিকয়েক লোক রাতারাতি টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। ”
পিডিবি সুত্র জানিয়েছে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ১২টি রেন্টাল ও ১৫টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে শুধু ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ২৫১ ডলার (ইউএস ডলার ৮০ টাকা) যা বাংলাদেশি টাকায় ২৫৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল আলম বলেন, “ বিদ্যুৎ খাতকে যেভাবে বেসকরারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমাদের সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। ”
“এভাবে বিশেষ কোন কোম্পানির হাতে বিদ্যুৎ খাত তুলে দিয়ে জনগণকে জিম্মি করার কোন মানে হয় না” বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১২
ইএস/এআর, সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর