ঢাকা: ভয়াবহ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন আরইবি (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) গ্রাহকরা। লাখেরও অধিক ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার যখন-তখন বিকল হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ট্রান্সফরমার জ্বলে গেলে বা বিকল হলে আরইবি’র গ্রাহকদের থেকে পুরো মাসুল আদায় করা হয়। কিন্তু, রাজধানীর ধনিক শ্রেণীর গ্রাহকদের ট্রান্সফরমার জ্বলে গেলে সরকারি খরচে পরিবর্তন করা হয়। একে ‘এক দেশে দুই আইন’ ও ‘বৈষম্যমূলক’ বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম।
আরইবি সূত্র জানায়, বিতরণ লাইন থেকে নির্দিষ্ট ভোল্টে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ট্রান্সফরমার বসানো হয়। চাহিদা ভেদে ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা একেক রকম হয়ে থাকে। আর আরইবিতে সর্বোনিম্ন পাঁচ কেভি থেকে ৭৫ কেভি পর্যন্ত ট্রান্সফরমার রয়েছে। নির্দিষ্ট ক্ষমতার বেশি চাহিদার সংযোগ হলেই তাকে ‘ওভারলোড ট্রান্সফরমার’ বলা হয়।
আরইবি জানিয়েছে, ওভারলোডেড হলে যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে যে কোনো ট্রান্সফরমার। তাদের ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার রয়েছে ৯১ হাজার একশ ৫৮টি (জুন ২০১৩), যা বিতরণ সংস্থাটির মোট ট্রান্সফরমারের ১৪.৪৯ শতাংশ। এ কারণে সকাল-বিকেল পটকার মতো ফুটছে ট্রান্সফরমার।
তবে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত আরইবি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের সংখ্যা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (কর্মাশিয়াল অ্যান্ড অপারেশন) কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, তার এলাকায় ৮০ শতাংশ ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড রয়েছে। গত বছর মাত্র ছয়টি পরিবর্তনের বরাদ্দ পান তিনি।
এদিকে, কীভাবে ওভারলোডেড হয়, এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক তদবির ও আরইবি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে ট্রান্সফরমারগুলো ওভারলোডেড হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকরা অনুমোদিত লোডের বেশি বাল্ব, ফ্যান ও ফ্রিজ ব্যবহার করছেন। এ কারণেও ওভারলোডেড হচ্ছে ট্রান্সফরমার।
কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার আগে পরিদর্শকরা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। গ্রাহক যে ট্রান্সফরমার থেকে সংযোগ পেতে চান, ওই ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা কত, আর বর্তমানে সংযোগ কতটি রয়েছে, সংযোগ দেওয়া যাবে কিনা, এ সব বিবেচনা করে সংযোগ দেওয়া হয়। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরইবি পরিদর্শকরা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া ছাড়পত্র দিচ্ছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম সংযোগ দেখানো হচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার। আর কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপের কারণে ওভারলোড জেনেও সংযোগ দিচ্ছে আরইবি। আর শেষ কারণটি হচ্ছে, গ্রাহক সংযোগ নেওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাহিদা ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু, সংযোগ পাওয়ার পর কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই বাড়তি বাল্ব, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ এয়ারকুলার বসাচ্ছেন। এতেও ওভারলোডেড হচ্ছে ট্রান্সফরমারগুলো।
নানা কারণে ওভারলোডেড হওয়া ট্রান্সফরমারগুলো পটকার মতো ফুটছে প্রতিনিয়ত। শহরের সামর্থ্যবান শ্রেণীর লোক বাস করেন। সেখানে ট্রান্সফরমার ফুটলে সেটা সরকার দিচ্ছে। অথচ পল্লীর নিম্নআয়ের লোকদের গলা চেপে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। কোথাও ট্রান্সফরমার জ্বলে গেলে ওই ফিডারের গ্রাহকদের থেকে সমুদয় টাকা নেওয়া হচ্ছে। সব টাকা একবারে না দিতে পারলে বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে কিস্তি করে জরিমানার টাকা আদায় করছে আরইবি।
এ জন্য সংস্থাটি ৫ কেভির ট্রান্সফরমার ৩৬ হাজার টাকা, ১০ কেভি ৫৩ হাজার টাকা অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্য আদায় করছে।
রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ও কর্মচারীদের অনিয়মের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েছেন গ্রাহকরা। ট্রান্সফরমার জ্বলে গেলে বিড়ম্বনা এড়াতে মুখ বুজে সব কিছু মেনে নিচ্ছেন তারা।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (কর্মাশিয়াল অ্যান্ড অপারেশন) কামরুজ্জামান স্বীকার করেন, গ্রাহকের কারণে ট্রান্সফরমার জ্বলে গেলে বা ওভারলোডেড হয়ে জ্বলে গেলে গ্রাহককে খরচ বহন করতে হয়।
আরইবির সদস্য (প্রকৌশল) প্রকৌশলী নুরুল আবসার বাংলানিউজকে জানান, ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সব ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করা প্রয়োজন, তার তুলনায় খুবই সামান্য পরিমাণ পরিবর্তন করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পরিবর্তন না করে আন্ডারলোড ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করা হয়েছে।
রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এ এ রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমিতিটিতে গত অর্থবছরে একশ ৮৭টি ট্রান্সফরমার পরিবর্তনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু, ঝুঁকিপূর্ণ ট্রান্সফরমার পরিবর্তন না করে আন্ডারলোড (নিরাপদ) ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সমিতিটির পীরগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু, ওই ট্রান্সফরমারগুলো ছিল আন্ডারলোডের। এর চেয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও তা পরিবর্তন করা হয়নি বিশেষ কারণে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ডিজিএম কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, পীরগঞ্জ উপজেলা সদরের সবগুলো ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড। সে কারণে বেশি ঝুঁকিপূর্ণগুলোই পরিবর্তন করা হয়েছে।
শুধু আরইবিতে নয়, অন্যান্য বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতেও ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার রয়েছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (ডিপিডিসি) ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার রয়েছে নয়শ ৯০টি। কোম্পানিটির মোট ট্রান্সফরমার রয়েছে ১০ হাজার পাঁচশ ৮১টি, যা মোট ট্রান্সফরমারের ৯ দশমিক ৪০শতাংশ।
ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে (ডেসকো) মোট ট্রান্সফরমার রয়েছে পাঁচ হাজার একশ ৮২টি, যার মধ্যে পাঁচশ ৯টি রয়েছে ওভারলোডেডে। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) পাঁচ হাজার ছয়শ চারটি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ওভারলোডেড রয়েছে একশ ৯১টি।
অন্যদিকে, দেশের একমাত্র সঞ্চালন লাইন পরিচালনকারী কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ’র (পিজিসিবি) দুইশ ৩২টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ওভারলোডেড রয়েছে ৩২টি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “বিগত সরকার বিদ্যুৎখাতকে বেহাল অবস্থায় রেখে গেছে। আমরা উৎপাদনের পাশাপাশি সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে অনেক কাজ করে যাচ্ছি। ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পরিবর্তন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ”
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৩
ইএস/ আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর