নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকার শঙ্করী সাহা প্রতিদিন গভীর রাত ২টা পর্যন্ত জেগে থেকে রান্না করেন। কারণ দিনের বেলায় তো গ্যাস থাকেই না আর সন্ধ্যার পর যা থাকে তাতে রান্না চড়ানো যায় না।
একই অবস্থা শহরের শহরের ডনচেম্বার এলাকার গৃহবধূ হাবিবা আক্তারের ক্ষেত্রে। তাকেও রান্না করতে হয় প্রত্যেকদিন রাত ১০টা কিংবা ১১টার পরে। সে খাবারই চলে পরের দিন। ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের ৬দিন অনন্যার স্বামীকে সকাল ৭টার মধ্যে বাসা ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু জ্বালানি গ্যাস সংকটের কারণে বিয়ের পর গত আড়াই বছর বছর যাবৎ তিনি বাসায় সকালের নাস্তা তৈরি করতে পারেন নি। গভীর রাতে কিংবা ভোর ৬টার আগে তাকে নির্ঘুমভাবে রান্না করতে হচ্ছে।
অনন্যা বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত রান্না ঘরের চুলায় গ্যাস পাওয়া যায় না। আবার বিকেল সাড়ে ৫ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে কিনে খাবার খেতে খেতে পেটের পীড়াসহ নানা অসুখ বিসুখ দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে মাসের খরচও বেড়ে গেছে।
শঙ্করী ও অনন্যার মতই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকদের। দিন দিন আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
শীতের প্রকোপ এখনো শেষ না হওয়ায় গ্যাসের চলমান সঙ্কট ভাবিয়ে তুলেছে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক লক্ষ আবাসিক ও বানিজ্যিক গ্রাহকদের। গ্যাসের ওপর উৎপাদন নির্ভরশীল ও ব্যবহৃত হয় এমন কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে নারায়ণগঞ্জের অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।
শহরের দেওভোগ, কাশিপুর, বাবুরাইল, পাইকপাড়া, শহীদ নগর, নলুয়াপাড়া, ভূঁইয়ারবাগ, চাঁনমারী, ইসদাইর, মাসদাইর, পশ্চিম মাসদাইর, জামতলা, দাতা সড়ক প্রভৃতি এলাকায় গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা কাশীপুর, মাসদাইর, বাড়ৈভোগ ও বিসিক শিল্প নগরীর আশপাশ এলাকায়। এসব এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না বললেই চলে।
মাসদাইর এলাকার কামাল আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, দুপুর একটার পর আস্তে আস্তে গ্যাস বাড়তে থাকে। যতটুকু সময় গ্যাস থাকে তাতেও রান্না করাটার বেশ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাস সিলিন্ডার ও স্টোভের দাম বেড়ে গেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডারপ্রতি ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা দাম বেড়েছে। এ কারনে অনেকে দুপুরে কেরোসিন,লাকরির চুলা বা ওভেনে রান্না করছেন। আবাসিক বাড়িতে গ্যাস সংকটের কারণে রান্নার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস নির্ভর শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে গ্যাস সংকট। এতে অচল হয়ে পড়েছে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস, ডাইং, প্রিন্টিং, স্টিল রি-রোলিং মিল। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত জেনারেটর, বয়লার অচল হয়ে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
গ্যাসের সংকট নিরসনের দাবিতে ‘নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি’ ও ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’ দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ, ঘেরাওসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করলেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
দাবি আদায়ে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে আধা বেলা হরতাল ডাকলেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তারা হরতালের কর্মসূচি স্থগিত করে। এছাড়া গ্যাস সঙ্কটের শিকার বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী এরই মধ্যে সঙ্কটের প্রতিবাদে ঝাড়ু মিছিল, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ, চাষাড়া বালুরমাঠে অবস্থিত তিতাস গ্যাস অফিস ঘেরাও, প্রায়শই শহরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান সহ নানা কর্মসূচী পালন করছে।
ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সঙ্কট বিরাজ করছে। ফতুল্লার কাঠেরপুল, সস্তাপুর, লালপুর, পঞ্চবটি, রসুলপুর, নন্দলালপুর, দাপা, পাগলা প্রভৃতি এলাকায় গ্যাসনির্ভর সহস্রাধিক রফতানিমুখী গার্মেন্টস, ডাইং, প্রিন্টিং, স্টিল রি-রোলিং মিল রয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে এসব শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সূত্র মতে, গ্যাস সরবরাহ ঠিকমতো না পাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাক যথাসময়ে বিদেশে শিপমেন্ট করতে পারছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের অর্ডার কমে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান মালিকরা শিকার হচ্ছে কঠিন আর্থিক লোকসানের। গ্যাস ঠিকমতো সরবরাহ না থাকলেও আগের মতোই গ্যাস বিল গুনতে হচ্ছে।
গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলানিউজকে জানান, গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এতে নিটওয়্যার মার্কেট হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জ হতে পঞ্চবটি পর্যন্ত ১৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের নতুন গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপন অনুষ্ঠানে পেট্রো বাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হোসেন মনসুর বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত গ্যাসের পাইপ স্থাপনের পর এসব এলাকার গ্যাসের সংকট দূর হয়ে যাবে। ৩ মাসের মধ্যেই এর সুফল জনগণ ভোগ করতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪