ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

অস্তিত্ব সংকটে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৪
অস্তিত্ব সংকটে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কাপ্তাই থেকে ফিরে: একসময় দশ টাকার নোটে ছিল কাপ্তাই বহুমুখী প্রকল্পের ছবি। বেশ কয়েক বছর তা নির্বাসিত।

প্রকল্পেও দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। কার্যত অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাই।

ক্যাচমেন্ট (প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকা) এলাকা থেকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (এফআইডিসি) গাছ কাটছে। কিন্তু আর লাগাতে দিচ্ছে না শান্তি বাহিনীর লোকজন। যে কারণে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম খান।
তিনি জানান, ছোট ছোট টিলাগুলো ইজারা দেওয়া হচ্ছে আগর গাছ লাগানোর জন্য। ঘুরলে দেখতে পাবেন চারপাশের টিলাগুলো সব খা খা করছে।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে গত ৩৩ বছরের বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ক্যাচমেন্ট এলাকায় বৃষ্টিপাত আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

১৯৮১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় সাড়ে সাত ইঞ্চি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৮৮ ইঞ্চি। ২০০৯ সালে ৯৬.৪৯, ২০১০ সালে ৮২.৩৪, ২০১১ সালে ৮৩.৫৫, ২০১২ সালে ৯০.৯১ ও ২০১৩ সালে বৃষ্টি হয়েছে ৮২.০২ ইঞ্চি।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আবদুর রহমান জানান, বৃষ্টির পানিই হচ্ছে এই কেন্দ্রের একমাত্র জ্বালানি। লেকের পানি একটি ট্যানেলের ভেতর দিয়ে গিয়ে টারবাইনে আঘাত করে। পানির চাপে ৫৫ টন ওজনের টারবাইনটি ঘুরতে থাকে। আর টারবাইনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রোটর ও জেনারেটর। যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।

পানি ছাড়া কোনোভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। কিন্তু পানির প্রধান উৎস হচ্ছে বৃষ্টি, আর বৃষ্টির জন্য প্রয়োজন গাছ। সেই গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

তিনি বলেন, পানি সংকটের কারণে ৫টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র একটি ইউনিট চালু রয়েছে। বর্তমানে রিজার্ভারে ৮৪.৬ ফুট পানি রয়েছে। এই পানি দিয়ে একটি ইউনিট মাত্র ৮১ দিন পর্যন্ত চালানো সম্ভব।

পুরাতন ইউনিটে ৬৮ ফুট ও নতুন ইউনিটে ৭৬ ফুটের নিচের পানি ব্যবহার করা যায় না। কারণ টারবাইনে ট্যানেলের মুখটি ৬৮ থেকে ১০৯ আর নতুনটি ৭৬ থেকে ১০৯ ফুট পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) নজরুল ইসলাম খান জানান, সুনিপুণ কৌশলে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাচমেন্ট এরিয়া ৪ হাজার ২৫০ বর্গমাইল।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রিজার্ভারের আয়তন ৩৪০ বর্গমাইল। অর্থাৎ রিজার্ভারটি ক্যাচমেন্ট এরিয়ার ১৪ ভাগের এক ভাগ। এমনভাবে এর পরিকল্পনা করা হয়েছে যে, যদি রিজার্ভারে এক ফোটা বৃষ্টি হয় তবে এর ১৪ গুণ পানি অর্থাৎ ১৪ ফোঁটা পানি (ক্যাচমেন্ট এরিয়ার পানি) রিজার্ভারে চলে আসবে এবং বিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হবে।

১৯৬২ সালে যখন এ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় তখন এই রিজার্ভারে বৃষ্টিপাত হতো গড়ে প্রায় ১০০ ইঞ্চি বা ৮ ফুট। আর ক্যাচমেন্ট এরিয়ার পানির সঙ্গে যোগ হয়ে মোট পানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১২ ফুট। অন্যদিকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্যও প্রয়োজন সর্বোচ্চ ১০৯ ফুট উচ্চতার পানি।

বর্তমানের পাঁচটি ইউনিটের পাশাপাশি ৫০ মেগাওয়াটের আরো দুটি ইউনিট স্থাপনের চেষ্টা চলছে। এটি করা সম্ভব হলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ৩৪৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যাবে।

এছাড়া লেকের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ৫০০ কিলোওয়াট থেকে ১ মেগাওয়াটের বেশ কিছু ছোট ছোট বিদ্যুৎ ইউনিট করার বিষয়ে ভাবছেন তারা। আশা করা হচ্ছে দ্রুত এ বিষয়টি ভালো সংবাদ পাওয়া যাবে।  

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আবদুর রহমান জানান, এমনিতেই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অত্যন্ত কম। গত বছরে এই কেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ২৩ থেকে ৪৮ পয়সা। সবগুলো ইউনিট চালানো গেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১০ পয়সায় নেমে আসবে।

আবদুর রহমান জানান, এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোন খরচ নেই। শুধু ব্যবস্থাপনা ব্যয় রয়েছে। প্রতি মাসে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়। পুরোদমে উৎপাদনে থাকলেও এই খরচ আর বন্ধ থাকলেও একই খরচ পড়ে।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্র জানায়, গত বছরে এই কেন্দ্র থেকে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ২৩ থেকে ৪৮ পয়সা। গত মার্চ মাসে উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিটে ৫৮ পয়সা।

মার্চে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২২ হাজার ৭৯৮ ইউনিট। ওই মাসে লুবওয়েল ক্রয়সহ মোট ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৭৫ হাজার ৭১২ টাকা। সে হিসেবে প্রতি ইউনিটের ব্যয় হয়েছে ৫৮ পয়সা।

২০১০, ১১, ১২ ও ১৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে যথাক্রমে, ৮৪ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৬৫, ৭৮ কোটি ৬২ লাখ ৩৭ হাজার ৯০০, ৮০ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার ৩০০ এবং ৭২ কোটি ৯৬ লাখ ২৭ হাজার ৮৯০ ইউনিট।

১৯৬২ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়। তখন দু’টি ইউনিটে মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। পরে ১৯৮৮ সালে এতে আরও ৩টি ইউনিট (প্রতিটি ৫০ মেগাওয়াট) স্থাপন করা হয়। সব মিলিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।

একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, অন্যদিকে সুপেয় পানির প্রধান অধার হিসেব গড়ে তোলা হয় এ প্রকল্প। একই সঙ্গে সঠিক মাত্রায় পানি ছেড়ে কর্নফুলী নদীকে জীবিত রাখারও চেষ্টা করা হয়। যাতে হালদার লবণপানি প্রবেশ করতে না পারে।

কিন্তু এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোন পরিকল্পনাই আর সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া না গেলে চরম সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।