মহারাষ্ট্র (ভারত) থেকে: মুনাফা ও দক্ষতা বিবেচনায় ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনকারী মহারত্ন, দ্বিতীয় নবরত্ন ও তৃতীয় ধাপে থাকা প্রতিষ্ঠানকে মিনি রত্ন কোম্পানি বলা হয়।
সে বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানিকে (এনটিপিসি) মহারত্ন কোম্পানি বলা হয়। কোম্পানিটি একাই ৪৩ হাজার ১২৮ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ২৩২ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ পড়েছে আড়াই রুপি। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি ওই বছর ৬৭ হাজার ৯৩১ কোটি রুপি মুনাফা করেছে।
আর এসব সম্ভব হয়েছে সাশ্রয়ী কয়লা ব্যবহারের কারণে। কয়লার ব্যবহারের কারণে শুধু এনটিপিসি নয় পুরো ভারতের বিদ্যুৎ খাত এখন প্রায় স্বস্তিতে।
দেশটি ব্যাপকহারে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধিতে মনোযোগী। ভারত দেশীয় কয়লা ছাড়াও অষ্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে কয়লা আমদানি করছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।
২০১৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের দুই হাজার সফল রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক কোম্পানির মধ্যে ৪২৪তম হয়েছে এনটিপিসি।
প্রতিবেশী দেশটির যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ (বিপিডিবি) ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে।
লোকসান ঠেকাতে বিগত ৬ বছরে ৭ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও সামাল দিতে পারছে না। দিতে হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি। এই লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যয়বহুল তেলের ব্যবহার। খোদ সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে কয়লা ছাড়া বিকল্প নেই, কয়লায় যেতে হবে।
দেশে একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে বড়পুকুরিয়ায়। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২৫০ মেগাওয়াট। সেখানে গড়ে সাড়ে ৩ টাকার মতো খরচ পড়ছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
এছাড়া তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১৮ টাকার মতো খরচ পড়ছে। এর বাইরে গ্যাস ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বিপিডিবি। তবে ব্যয়বহুল তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি কিছুতেই লোকসান নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এখন বলা হচ্ছে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারলে সংকট কেটে যাবে। কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে দেশের মধ্যেই নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যার ক্ষেত্র সরকার নিজেই প্রস্তুত করে রেখেছে। ফলে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এ নিয়ে বিতর্কের অন্যতম কারণ ক্ষেত্রটি সুন্দরবনের নিকটবর্তী।
বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ভারতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে রাতদিন পার্থক্য। বিশাল আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা তাদের পথচলাকে সহজ করে দিয়েছে।
ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের সিপাত দুই হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট ও মহারাষ্ট্র রাজ্যে আদানী গ্রুপের ‘তিরোরা ৩৩’শ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে এমন প্রশ্ন বারবারেই মনের মধ্যে উকি দিয়েছে। কেন্দ্র দু’টিতে বাংলাদেশের সমান বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে।
বিশাল আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টির কম্পাউন্ড এবং কম্পাউন্ড ঘেঁষা এলাকা ঘন সবুজে ঘেরা। চারিদিকের মনোরম পরিবেশ চমকে যাওয়ার মতো। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে জটিল বিষয় হচ্ছে কয়লা ও অ্যাশ (ছাই) ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এখানেও রয়েছে চমৎকার সমন্বয়।
ইএসপি ব্যবহারের কারণে চিমনি দিয়ে কোনো রকম ছাই উড়তে দেখা যায়নি। যে কারণে ভারতীয়দের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তেমন বিরোধীতা নেই। ফলে সহজেই নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে দেশটি।
ভারত ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এরমধ্যে কয়লা দিয়েই উৎপাদিত করছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৩১০ মেগাওয়াট।
অন্যদিকে, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৫০ মেগাওয়াটে আটকে আছে বাংলাদেশ। সেখানেও নানা রকম জটিলতায় আবদ্ধ। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইএসপি বিকল থাকা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে চিমনি দিয়ে সবসময় ছাই উড়ছে বাতাসে। এটা স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করে তুলছে।
আর এর প্রভাব পড়ছে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপনের সময়। অথচ সরকার চাইলেই পারে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংস্কার করে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করতে।
আর তেমনটি হলে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর সময় জনগণের কোনো আপত্তি থাকত না। তাতে এনটিপিসির মতো মহারত্ন না হলেও মুনাফায় যাওয়া কঠিন বিষয় নয় বিপিডিবির।
কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ টাকা। আর বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দর রয়েছে ৬.১৫ টাক। কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে বর্তমান দামেই এনটিপিসির মতো হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করতে পারে বিপিডিবি।
মহারাষ্ট্রের গুন্ডিয়া জেলার তিরোরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন শেষ। এবার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত হাওড়া রেল স্টেশন দুরত্ব ১ হাজার ১৩১ কিলোমিটার। এবার বাহন ‘আজাদ হিন্দ একপ্রেস’। ট্রেনটি পুনে থেকে হাওড়া যাচ্ছিল। মোট ২ হাজার ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
এবারও সেই আগের বগি। যে বগিটি ৫ দিনের জন্য ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকায় রিজার্ভ করা। ব্যবহারকারীর গন্তব্যই ঠিক করে দেয় কোন ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হবে বগিটি।
কয়েক দিনের যাত্রায় আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস ছাড়াও নাগপুর এক্সপ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যথা সময়ে নির্দষ্ট গন্তব্য পৌঁছে দিয়েছে। কখনও এক মিনিট বিলম্ব হয়নি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে।
বুধবার স্থানীয় সময় বেলা পৌনে ৩টায় ছত্তিশগড়ের প্রাদেশিক রাজধানী রায়পুর পৌঁছে যায়। সেখানে এনটিপিসির পক্ষ থেকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। আগে থেকেই সেখানে ছিলেন এনটিপিসির (ছত্তিশগড়) ডিজিএম দয়া শর্মা।
গরম লাঞ্চ বক্স। তাকে সাহায্য করছিলেন একজন কুলি। কতক্ষণ আগে এসেছেন, জানতে চাইতেই বাংলানিউজকে বলেন, মাত্র ১০ মিনিট আগে এসেছি। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে ভাবতে থাকি দেশটির ট্রেন সার্ভিসের কথা।
বাংলাদেশের ট্রেনে এই রকম খাবার পৌঁছে দিতে হলে তাকে কতক্ষণ আগে রওয়ানা দিতে হতো। আর কত অপেক্ষা করতে হতো। আর গরম থাকলে শেষ পর্যন্ত সেই খাবার খাওয়ার উপযোগী থাকত কি-না? চলছে গাড়ি হাওড়ার পথে.... (চলবে)।
** এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নগাথা সিপাত বিদ্যুৎকেন্দ্র
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪