ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুৎ বিভাগ

‘বিশেষ বিধান’ এ ভর করে ফের দরপত্র ছাড়াই কার্যাদেশ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
‘বিশেষ বিধান’ এ ভর করে ফের দরপত্র ছাড়াই কার্যাদেশ

ঢাকা: বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটিকে সামনে দাঁড় করিয়ে আবারও দরপত্র ছাড়াই পছন্দ মতো কোম্পানি বেছে নিয়ে এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকার ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে কঠিন শর্তের (আনসলিসিটেড বা অযাচিত ঋণ) এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বিষয়টি বিবেচনার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) চিঠি পাঠানো হয়।

এর মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পে ১০৫ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দুটি প্রকল্পে ৫৯৭ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে তিন হাজার মিলিয়ন ডলার, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের দুটি প্রকল্পে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি  প্রকল্পে এক হাজার ৩২২ মিলিয়ন ডলার, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি প্রকল্পে তিন হাজার ৩৯৩ মিলিয়ন ডলার, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি প্রকল্পে ১৬ মিলিয়ন ডলার, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের চারটি প্রকল্পে দুই হাজার ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।

আনসলিসিটেড ঋণ অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি তারাই অর্থায়নের উৎসের সন্ধান দেবে এবং পুরো বিষয়টি সমন্বয় করবে। তবে এক্ষেত্রে ঋণে সুদের হার বা অন্যান্য শর্ত নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ থাকে না বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি হয়। নানান শর্তও থাকে। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার সুযোগও থাকে না। তাই পণ্যের দাম বেড়ে যায় কিন্তু মান নিশ্চিত করা যায় না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মানুযায়ী কাজ শুরুর আগে ক্রয় নীতিমালার (পিপিআর) আলোকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোয় এ নীতি মানা হবে না।

যেহেতু চীন থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, শর্ত মানতে এখন দেশটির কোনো কোম্পানির মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হবে। ফলে এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকার ১৫টি প্রকল্প দরপত্র ছাড়াই চীনা কোম্পানিকে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এসব কেন্দ্র নির্মাণের কাজও কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই ওই সব দেশের কম্পানিগুলোকে দেওয়া হবে।

নাম গোপন রাখার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র না ডেকে প্রকল্পের কাজ বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ কিংবা মোটা অঙ্কের দুর্নীতির আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে দেশের স্বার্থ।

এর আগে ২০১৪ সালের অক্টোবরে সিরাজগঞ্জে ৪১০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেওয়া হয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি সেমব্যাকরোপকে।

বিদ্যুৎ বিভাগ পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই চীনা কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) যৌথ মূলধনীতে এ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। এর জন্য খরচ পড়বে প্রায় দেড় বিলিয়ন (১৫০ কোটি) ডলার। আমদানি করা কয়লা দিয়ে কেন্দ্রটি চালানো হবে। এ ছাড়া চীনের দুটি কোম্পানি বাংলাদেশে দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র করার জন্য সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। প্রতিটি এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নও করবে চীনা এক্সিম ব্যাংক।

বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়েই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ওই অর্থ পেতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। ঋণের ব্যবস্থা করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) অনুরোধ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগের সাত বছরে দেশের বিদ্যুৎ খাতে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ে বিরক্ত ছিল মানুষ। নতুন সংযোগের অভাবে ধুঁকতে থাকে কল-কারখানাগুলোও। ওই সময় সরকার মানুষের দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি বিশেষ আইন-২০১০’ অনুমোদন করে সরকার।

২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এ আইন নবায়ন করে সরকার। এর অধীনে দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, চীনের প্রস্তাবিত ঋণের সুদের হার অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার ঋণের সুদ হারের তুলনায় অনেক বেশি। তাই চীনের প্রস্তাবিত ঋণকে ‘নন-কনসেশনাল’ বা কঠিন শর্তের ঋণ বলে অভিহিত করেছে ইআরডি। বর্তমানে চলমান প্রকল্পগুলোর গ্রেস পিরিয়ড সাত বছর। অর্থাৎ ঋণ পাওয়ার পর প্রথম সাত বছর কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হয় না। এসব ঋণের সুদের হারও ২ শতাংশ। কিন্তু চীনের শর্ত হলো, প্রকল্পের অর্থপ্রাপ্তির আগেই ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ১৫ শতাংশ অর্থ ফেরত দিতে হবে। ২০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করারও শর্ত রয়েছে। এ ছাড়া কমিটমেন্ট ও ম্যানেজমেন্ট ফি ০.২ শতাংশ করে মোট ০.৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি সুদ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের উপকরণ চীনা কোম্পানির কাছ থেকে কেনারও শর্ত রয়েছে।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলও সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। ওই আলোচনায় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকল্পের কাজ বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি।

একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দরপত্র ছাড়া বরাদ্দ দেওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের সমালোচনা হয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও।

ওই কমিটির এক বৈঠকে বিবিধ বিষয় হিসেবে দরপত্র ছাড়াই সরকারি কেনাকাটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক বলেছেন, দরপত্র ছাড়া কেনাকাটায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রয় প্রতিযোগিতামূলক হয় না। আবার অনেক সময় আলোচনার মাধ্যমে মূল্য কিছুটা কমিয়ে ক্রয় প্রস্তাব প্রণয়ন করে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এ ধরনের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের পর অনেক ক্ষেত্রে ভেরিয়েশনের মাধ্যমে ক্রয়মূল্য বেড়ে যায়।

জানা গেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ‌ও চায় না আনসলিসিটেড ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক। কারণ, এসব ঋণে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যদিও গত ১২ আগস্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়। এর মধ্যেই কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে দরপত্র ছাড়া বৃহৎ এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের অনুমোদন করিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাভবান হলেও দেশ ও বিদ্যুৎ খাতের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশের ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার বিকল্প নেই।

যদিও সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, চীনের ঋণ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৫
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।