ঢাকা: শব্দের মারপ্যাচে জটিল করে তোলা হয়েছে কনোকোর সঙ্গে সম্পাদিত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি। অনেক ক্ষেত্রে মডেল পিএসসি ২০০৮ অনুসরণ না করা এবং দরপত্রের বাছাইয়ের পরে কনোকোকে বিশেষ ছাড় দেওয়ায় অভিযোগ উঠেছে।
শব্দ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ বাড়তি সুবিধা পাবে কনোকো ফিলিপস। সে কারণে চুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেছেন, ২০০৮-এ যে মডেল পিএসসি চূড়ান্ত করা হয় সেটিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কনোকোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় আরো অনেক বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মডেল পিএসসি প্রণয়ন কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে যখন গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। তখন ৭টি কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। ’
‘মূল্যায়ন কমিটি আমেরিকান কোম্পানি কনোকো ফিলিপসকে ১০,১১,১২,১৫,১৬,১৭,২১ এবং ২৯ নম্বর ব্লকে (মোট ৮টি) কাজ দেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত মায়ানমানের সঙ্গে বিরোধ থাকায় শুধুমাত্র ১০ ও ১১ ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য পিএসসি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেয় একনেক (২৪ আগস্ট ২০০৯)। ’
‘সে সময়ে দরপত্রের সব শর্ত মেনে নিয়ে কনোকো ফিলিপস অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কনোকো ফিলিপসকে পরে বেশ কয়েকটি বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। ’
‘দরপত্রের পরে কনোকোকে ছাড় দেওয়ায় দরপত্রে অংশগ্রহণকারীরা যদি সরকারের নৈতিকতার প্রশ্ন উপস্থাপন করে তাহলে ভুল হবে না। এখন যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে সেসব শর্তে অন্যান্য কোম্পানিগুলো আরো বেশি হিস্যা বাংলাদেশকে দিলেও দিতে পারত। ’
‘মডেল পিএসসিতে শর্ত ছিল, আরবিট্রেশন (আইনী জটিলতা নিরসনে) বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ঢাকার আদালতে ফয়সালা করা হবে। কিন্তু সেখানে পরিবর্তন করে বলা হয়েছে ঠিকাদার যদি সিঙ্গাপুরে রাজি না হয় সেক্ষেত্রে আরবিট্রেশন হবে ঢাকায়। ’
‘মডেল পিএসসিতে গ্যাসের পরিমাপ পয়েন্ট নির্ধারণে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল পেট্রো বাংলাকে। কিন্তু সেখানে পরিবর্তন করে ডেভলপমেন্ট প্লানে যেখানে হয় সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এফিসিয়েন্সি (অদক্ষতার ) কারণে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য ঠিকাদার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু অদক্ষতার শব্দ তুলে দিয়ে যদি অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তাদের দায়ী করা হয়েছে। ’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া দুরহ হবে। কারণ তারা তখন বলবে আমরা অবহেলা করিনি। আমাদের অদক্ষতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ’
তিনি আরো দাবি করেছেন, ‘এখন গ্যাস আনতে গেলে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে সরকারকে। আর যদি পরিমাপ পয়েন্ট নির্ধারণের ক্ষমতা পেট্রোবাংলার হাতে থাকত তাহলে আমরা পরিমাপ পয়েন্ট স্থলভাগে কোথায় নির্ধারণ করবে জানালে- তারা বাধ্য হতো সেখানে গ্যাস পৌঁছে দিতে। ’
একটিমাত্র শব্দের হেরফের করে কনোকোকে বড় ধরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘কনোকোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি দেশের স্বার্থের স¤পূর্ণ পরিপন্থি। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ মাত্র ২০ ভাগ গ্যাস পাবে আর কনোকো ফিলিপস পাবে ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া কনোকো ফিলিপসকে গ্যাসকে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) করে রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে করে দেশের গ্যাস চলে যাবে বিদেশে। ’
বাংলাদেশ না নিতে চাইলে তখনই শুধু কনোকো ফিলিপস তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে- সে বিষয়ে বলা আছে তাহলে তো এ আশঙ্কা থাকে না? এ প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে যেহেতু তাদের তল্পিবাহক এবং তাদের দ্বারা সুবিধাভোগির অবস্থান করছে তারা সে ব্যবস্থাও পাকা করে দেবেন। ’
‘কনোকো যেহেতু বিদেশে রপ্তানি করলে বেশি দাম পাবেন সে কারণে তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যাতে সরকার বাধ্য হবে রপ্তানি করার সুযোগ দিতে। ’
তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। যার নজীর বিশ্বে রয়েছে। ’
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড: হোসেন মনসুর চুক্তি পরবর্তী উল্লেখিত বিষয়ে পরিবর্তনের সত্যতা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘টেন্ডারের নিয়মই এ রকম। টেন্ডারের পরে পার্টির সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করা হয়। ’
পরিমাপ পয়েন্ট নির্ধারণে পেট্রোবাংলার ক্ষমতা খর্ব করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ডেভলপমেন্ট প্লানে যেখানে হয় সেটাই তো হওয়া উচিত। ’
‘অদক্ষতার কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কনোকোকে বহন থেকে ছাড় দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমরাতো কোন অদক্ষ কোম্পানিকে কাজ দেইনি। সে কারণে এ শব্দটি যুক্তি সংগত নয় বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। ’
কনোকো গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে কানাডায় ২টিসহ অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তাকে অবহিত করলে তিনি বলেন, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হয়। ’
তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, তোমরা কি দেশের ভালো চাওনা? আমরা কি দেশের স্বার্থের চেয়ে কনোকোর স্বার্থ বেশি দেখব?
‘সব সময় দেশের স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়া উচিত - কিন্তু সব সময় সেটি হয়না। সে কারণে বেশি ভয় বাঙালির বলে জানালে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, তোমাদের মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। বিদেশি কেউ এসে গ্যাস তুলে দিয়ে চলে যাবে না। তারা তাদের ব্যবসার কথা চিন্তা করবেই। ’
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই-এলাহী ব্যস্ত রয়েছেন বলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘন্টা, জুন ১৯, ২০১১