ফরিদপুর থেকে: ফরিদপুরে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টটি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী ২৮ আগস্ট এর উৎপাদন শুরুর টার্গেট বেঁধে দেওয়া হলেও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে টেস্ট রান বা পরীক্ষামুলক উৎপাদন।
প্রকল্প পরিচালক জহিরুল ইসলাম মজুমদার বাংলানিউজকে বললেন, ‘প্রয়োজনীয় ফার্নেস অয়েল পেলে এই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা সম্ভব। ’
তার এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেলো প্ল্যান্টটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন রশীদের বক্তব্যেও।
বাংলানিউজকে তিনিও বলেন, ‘তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে এই মুহূর্তেই কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারবে। ’
এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর জুড়ে শিল্পায়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম জুট মিল নির্মাণের কাজ শুরু করেছে করিম গ্রুপ। পৃথক আরেকটি স্থানে জুট মিল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে পারটেক্স গ্রুপও।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় পৌরসভার মেয়র শেখ মাহাতাব আলী মেথু বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে দ্রুতই এ অঞ্চলের চেহারা বদলে যাবে। ’
প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই-এলাহী বাংলানিউজকে বলেছেন, ‘আমরা আশাবাদী ফরিদপুরসহ সকল কেন্দ্র যথা সময়ে উৎপাদনে যাবে। ’
তবে জহিরুল ইসলাম মজুমদার ও হুমায়ুন রশিদের বক্তব্য অনুযায়ী- তেল সরবরাহের নিশ্চয়তাই এখন ফরিদপুর জেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-ফরিদপুর মহাসড়কের ধুনদীতে ৩৮০ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা সরকারি ব্যয়ে নির্মীয়মান কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
হুমায়ুন রশীদ বলেন, ১৫ আগস্ট প্রকল্পটি সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু বাকি রয়েছে রেলের ওয়াগন থেকে তেল সরবরাহের পাইপ বসানোর কাজ। ’
‘রেল লাইন বসানোর কাজ শেষ হলে ৭ দিনের মধ্যে পাইপ বসানোর কাজ শেষ করা হবে’ বলেও জানান তিনি।
তাদের আশংকা, যথা সময়ে রেল লাইন স্থাপন করতে ব্যর্থ হলে উৎপাদনে যেতে বিলম্ব হতে পারে।
তাই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) খুলনা থেকে পাটুরিয়া হয়ে জ্বালানি সরবরাহ করবে। এজন্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা (ফরিদপুর)-পাটুরিয়া (রাজবাড়ী) ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
রেলওয়ে পাকশী জোনের বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ এএফএম মাসুদ-উর-রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৫ আগস্টের মধ্যেই রেল চলাচলের জন্য লাইন উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ’
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্র জানিয়েছে, পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী কেবল পিক আওয়ারে (বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা) এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। তবে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আরো বেশি সময় এটি চালানো হতে পারে। সেক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা কেন্দ্রটি চালু রাখতে দৈনিক ২৫০ মেট্রিক টন জ্বালানি প্রয়োজন পড়বে।
ফার্নেস অয়েলকে কেন্দ্রটির প্রধান জ্বালানি নির্ধারণ রয়েছে’ জানিয়ে হুমায়ুন রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘কেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রতি ঘণ্টায় ১১ থেকে ১২ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল প্রয়োজন হবে। ’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই প্রতিনিধি বলেন, ‘টারবাইন ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ১শ’ টাকার গ্যাস পুড়িয়ে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। আর ইঞ্জিন ভিত্তিক এই কেন্দ্রটি সমপরিমাণ জ্বালানি পুড়িয়ে ৪৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। ’
তিনি বলেন, ‘এই কেন্দ্র মাত্র ২০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে চালু করা সম্ভব। একই ক্ষমতা সম্পন্ন টারবাইন বেইসড বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে প্রায় ৫ হতে ৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন পড়ে। ’
উৎপাদন প্রস্তুতির ফিরিস্তি দিয়ে হুমায়ুন রশীদ বলেন, ‘আনলোডিং, ট্যাংক ইয়ার্ড, ফুয়েল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এফটিপি), ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ( ডব্লিউটিপি), ইঞ্জিন রুম ও সাব স্টেশন ইয়ার্ড নির্মাণ এবং ইঞ্জিন সুইচ রুমের কাজ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে এসব ইঞ্জিনের সফল পরীক্ষাও চালানো হয়েছে। ’
তিনি জানান, কেন্দ্রটির জন্য নরওয়ের বিখ্যাত রোলস রয়েস কোম্পানি থেকে ৮টি ইন্টারনাল করভারশন ইঞ্জিন (অন্ত:দহ ইঞ্জিন) আনা হয়েছে। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৫৪ মেগাওয়াট। প্রতিটি ইঞ্জিনের ওজন প্রায় ১০৭ মেট্রিক টন।
সাব স্টেশন ইয়ার্ডে ট্রান্সফরমার, কারেন্ট ট্রান্সফরমার (সিটি) ও প্ল্যান্ট ট্রান্সফরমার (পিটি) বসানো হয়েছে।
জ্বালানি রিজার্ভের জন্য ট্যাংক ইয়ার্ডে বসানো হয়েছে ৯টি টাংকি। এর মধ্যে ৫ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন দু’টি ফার্নেস অয়েল রিজার্ভার, একটি ৫শ’ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ডিজেল রিজার্ভার, ১ হাজার টন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি এইচএফও বাফার ও ৫টি লুব ওয়েল রির্জাভার ট্যাংকি রয়েছে।
পরিবেশ দুষণমুক্ত রাখতে ৫২ মিটার উচ্চতার চিমনি স্থাপন করা হয়েছে।
হুমায়ুন রশীদ আরো জানান, ইঞ্জিন বেইস বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করতে ২০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগবে। এজন্য ৫শ’ কেভিএম ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল চালিত জেনারেটর বসানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে লোড কমে গেলে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই এটি বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আবার চালু করতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট। ’
বিপিডিবি এর মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার পর ৬ বছর পর্যন্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকৌশলী দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এ সময়ে তাদের প্রায় ২০ জন প্রকৌশলী কর্মরত থাকবে। প্রকৌশলীদের বেতনও বহন করবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
এ সময়ে (৬ বছর) কোন ধরণের ক্রটি দেখা দিলে তার সার্বিক দায়িত্ব বহন করবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড।
বিদেশি প্রকৌশলী না এনে দেশি প্রকৌশলী দিয়ে কেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণ করায় অনেক বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হবেও দাবি করছে ঠিকাদার সূত্র।
এক প্রশ্নের জবাবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘এই দেশে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। আমাদের কোম্পানিতে ১৮০ জন দক্ষ প্রকৌশলী কর্মরত আছেন। আমরা এ পর্যন্ত ক্যাপটিভ মাকের্টে আড়াই থেকে তিনশ’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ারের ৭০ থেকে ৮০ টি সাব স্টেশন স্থাপন করেছি আমরা। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘন্টা, জুলাই ৩১, ২০১১