ফেনী থেকে ফিরে: ভারতীয় ঠিকাদার নির্মাণ করা দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর তা বিকল হয়ে পড়ে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ছ’বছর।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে দেশজুড়ে নানা উদ্যোগ নিলেও বিকল পড়ে থাকা এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ সামান্য ব্যয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দশমিক ৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনে ব্যয় হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময় বন্ধ হয়ে গেলে কেন্দ্রটি চালু করা নিয়ে আর কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া হয়নি। ফলে কার স্বার্থে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলো সে প্রশ্ন এখন ফেনীবাসীর।
সমুদ্র সৈকত থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সাগর মোহনা সোনাপুর গ্রামে ২০০৪ সালে ২৩ জানুয়ারি এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারির মাসে শেষ হয় এর অবকাঠামো তৈরির কাজ।
আর এ কাজে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছিলো ভারতের নেবুলা টেকনো সলিউশন্স লিমিটেডকে।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই পরীক্ষামূলক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হয়। অল্পদিনের মাথায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় নিয়েও রয়েছে দু’রকম কথা।
কেউ কেউ বলছেন, পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। আবার কেউ বলছেন ২ মাস চালু থাকার কথা।
ফেনী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির তৎকালীন সভাপতি আবদুল মোতালেব বাংলানিউজকে জানান, খুব বেশি হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ মাস চালু ছিল। সে সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড করা হয় মাত্র দশমিক ২৫ মেগাওয়াট।
তবে সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ ফরিদ বাংলানিউজকে বলেন অন্য কথা: ‘উদ্বোধন করে লোকজন চলে যাওয়ার পরপরই বন্ধ হয়ে যায়। খুব বেশি হলে ৩০ মিনিট চালু ছিল। ’
এখানে ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার, জেনারেটর, কন্ট্রোল প্যানেল, সাব- স্টেশন, ব্লেড, ম্যাচিং গিয়ার এলিমেন্ট স্থাপন করা হয় এবং প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারের মাথায় দেড় টন ওজনের পাখা লাগানো হয়।
মুহুরী সেচ প্রকল্প থেকে যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণ করা হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানোর জন্য ্সামান্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়।
এ কারণে স্থানীয় পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি থেকে একটি ১১/০.৪ কেভি লাইনের সংযোগ টানা হয়। বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য টু-ওয়ে মিটার স্থাপন করা হয়।
বাতাসের বেগের সঙ্গে বিশাল আকারের পাখা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার কথা।
কথা ছিল প্রতি সেকেন্ডে দশমিক ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করবে ঠিকাদার। কিন্তু ঠিকাদারের কথা বায়ুকলের বায়ুর মতো হাওয়া হয়ে গেছে।
আর সরকারও এ ব্যাপারে কোনও খোঁজ খবর করেনি বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সদস্য (জেনারেশন) আবুল কাশেম।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, যান্ত্রিক ক্রটির কারণে উৎপাদনে যাওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঠিকাদারকে পুরো বিল পরিশোধ করা হয়নি।
তবে কী পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে তাও তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে চাননি।
তিনি বলেন, ‘নির্মাণগত ত্রুটির কারণে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ই এটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করার বিষয়ে আর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ’
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করার বিষয়ে সরকারের কোনও পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাওয়া হলে জবাবে আবুল কাশেম বলেন, ‘আমাদের দেশে বাতাস অনেক কম। এ কারণে এটি চালু করেও ভালো ফল পাওয়া যাবে না। ’
এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এছাড়া এখন প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। ’
বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। টাওয়ার এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশের মধ্যে ধরেছে মরিচা। অযতœ-অবহেলায় এটি অচিরেই নষ্ট হওয়ার পথে।
সাধারণের নাগালের বাইরে রাখার জন্য কোনও সীমানা প্রাচীর বা অন্য কোনও প্রতিবন্ধকতাও নেই। এ কারণে এলাকাটি এখন গরুর খামারে পরিণত হয়েছে।
সোনাগাজী বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক খিজির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হজে যাবেন বলে এ ব্যাপারে বাংলানিউজের কাছে কোনও কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
তবে দু’একটি প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন বলেও জানান তিনি।
তাই বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সর্বশেষ কী অবস্থা জানতে চাইলে খিজির বলেন, ‘দেশ চোরে ভরে গেছে। এই কেন্দ্র চালু করলে তো তেমন লাভ হবে না। আর নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে লুটেপুটে খাওয়া যাবে। সে কারণে এটি চালু করা হচ্ছে না। ‘
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে কী পরিমাণ ব্যয় হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার ব্যয় জানার কী প্রয়োজন ?’
পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময়ে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি উষ্মার সঙ্গে বলেন, ‘কোন শয়তানে বলেছে ?’
খিজির খান বর্তমানে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে একটি মহল লুকোচুরি খেলছে। তারা চায় না এ বিষয়ে ঘাঁটাঘাটি হোক। ’
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পটির বিষয়ে সঠিক তদন্ত করা হলে অনেক মহারথী ধরা খাবে। তাই সঠিক তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। ’
তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়্যারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর বললেন অন্য কথা।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক দিন আগে করা হয়েছিলো এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে কাজ না করায় তাদের চূড়ান্ত বিল দেওয়া হয়নি। সেটাই তো বড় শাস্তি। ’
এরপরে আর বিষয়টি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায় বাংলানিউজকে জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সার্বিক অবস্থার রিপোর্ট দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রিপোর্ট পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১১