চট্টগ্রামঃ মাত্র দেড় মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হলেও চট্টগ্রামে টাকা জমা দিয়ে সংযোগের অপেক্ষায় থাকা সাড়ে ১৪ হাজার আবাসিক গ্রাহকের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ি বানিয়েও ভাড়া দিতে পারছেন না মালিকরা।
অন্যদিকে গ্যাস সংযোগ থাকা বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ভাড়াটিয়া ও মালিকসহ সর্বস্তরের মানুষকে। অথচ সরকারি সিদ্ধান্তের অভাবে সব প্রক্রিয়া শেষ করেও সংযোগ পাচ্ছেন না আবাসিক বাণিজ্যিক ও শিল্প কারখানাসহ প্রায় ১৫ হাজার প্রতিশ্রুত গ্রাহক।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) সূত্র জানায়, প্রতিশ্রুত ১৪ হাজার ৬৯১ জন আবাসিক গ্রাহকের জন্য গ্যাস প্রয়োজন মাত্র ১ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট, আর বাকি ৬৮টি বাণিজ্যিক ও শিল্প গ্রাহকের জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
উল্লেখ্য, ২০০৯-এর মাঝামাঝি থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিকসহ সব ধরনের সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রতিশ্রুত ১৫ হাজার গ্রাহকের পাশাপাশি গ্যাসের জন্য আবেদনকারি গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজারে।
এ প্রসঙ্গে কেজিডিসিএল ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি একরাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামকে দেশের ‘স্বর্ণদ্বার’ বলা হলেও চট্টগ্রাম সবসময় অবহেলিত হচ্ছে। এই বৈষম্য দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। টাকা জমা দিয়েও সংযোগ না পাওয়ায় গ্রাহকদের কাছে আমাদের হেনস্তা ও নিগৃহীত হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে ঠিকাদারও তাদের কর্মচারিরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। কেজিডিসিএল খুব সহসা সংযোগ দেওয়া শুরু না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচী দেওয়া হবে বলে জানান একরাম চৌধুরী।
এ অবস্থায় প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ না দেওয়ায় মামলার আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, মাত্র দেড় মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হলেও সাড়ে ১৪ হাজার আবাসিক গ্রাহককে সংযোগ না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে কেজিডিসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সানোয়ার হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারি আদেশবলে চট্টগ্রামে আবাসিকসহ সব ধরনের গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা সরকারের নীতি নির্ধারণী ব্যাপার। সরকার আবার নির্দেশ দিলে আমরা সংযোগ দেয়া শুরু করবো। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চাহিদার তুলনায় এখনো অনেক ঘাটতি আছে। সেমুতাংয়ের গ্যাস দুটি সার কারখানায় দেওয়া হলেও এখনো চট্টগ্রামের গ্যাসভিত্তিক সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ আছে। ’
জানা গেছে, গ্যাস সঙ্কটের কথা বলে কেজিডিসিএলে নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা হলেও সিলেটে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়নি। ওই অঞ্চলের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কারণে সিলেটে কখনো গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকেনি বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অপর প্রভাবশালী মন্ত্রীর কারণে রাজশাহীতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য নতুন পাইপলাইন ও নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ সেখানে গ্যাস সরবরাহ করার কথা রয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে দীর্ঘ প্রায় আড়াই বছর গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চট্টগ্রামবাসী।
তাদের অভিযোগ বাণিজ্যিক রাজধানী হয়েও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে চট্টগ্রাম। অব্যাহত গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের জন্য চট্টগ্রামে আটকে আছে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহবুবুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম হচ্ছে রিজিওনাল হাব, দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বন্দরের অবস্থান চট্টগ্রামে। কিন্তু মুখে বাণিজ্যিক রাজধানী বলে সরকার রাজশাহী, সিলেটসহ অন্য এলাকায় গ্যাস দিলেও চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য এলাকায় গ্যাস সরবরাহ নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তা না হলে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে চলবে? গ্যাস, বিদ্যুৎ না থাকলে বিদেশিরা কেন আসবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘সেমুতাং থেকে গ্যাস সরবরাহের পর সে গ্যাস সিইউএফএলে দেওয়া হয়েছে সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমাদের দাবি থাকবে সালদার গ্যাস যেন প্রতিশ্রুত আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প গ্রাহকদের দেওয়া হয়। ’
এদিকে, আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রসঙ্গে রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট আব্দুল কৈয়ুম চৌধুরী শনিবার বাংলানিউজকে বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় চট্টগ্রামে প্রায় চার হাজার ফ্ল্যাট গ্রাহকদের কাছে হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে পূর্ব থেকেই তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া গ্রাহকরা ফ্ল্যাট নিতে চাচ্ছে না। তাই সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ অন্তঃত প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের যেন সংযোগ দেওয়া হয়। ’
এদিকে সালদার গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প কারখানা না কি আবাসিক গ্রাহকদের দেওয়া হবে এ ব্যাপারেও এখনো কোনো নির্দেশা পায়নি কেজিডিসিএল।
অন্য এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হলেও চট্টগ্রামে সংযোগ বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে কোতোয়ালী আসনের সরকার দলীয় সংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘সালদার গ্যাস পেলে সংযোগের অপেক্ষায় থাকা আবাসিক গ্রাহকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেজিডিসিএল গ্যাস দেবে। এ বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। ’
তবে এ ব্যাপারে কেজিডিসিএল এখনো কোনো নির্দেশনা পায়নি উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক সিদ্ধান্ত আসতে দেরি হয়। ’
সালদা থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হলেও কিছু টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে কেজিডিসিএল এখনো সে গ্যাস পাচ্ছে না বলে নুরুল ইসলাম বিএসসি জানান।
কেজিডিসিএল সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সংস্থাটি সরবরাহ করতে পারছে মাত্র ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি থাকছে আরও ১৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এ অবস্থায় কেজিডিসএলের সবচেয়ে বড় তিন গ্রাহক সিইউএফএল, কাফকো ও পিডিবিকে একসঙ্গে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। একটিতে গ্যাস সরবরাহ করলে অন্যটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
এর মধ্যে সংস্থার তিন লাখ ৬৬ হাজার আবাসিক গ্রাহককে বিতরণ করা হয় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর বাকি গ্যাস সরবরাহ করা হয় শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১১