মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি থেকে ফিরে : ধারাবাহিক লোকসানের পরও মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানিকে লাভজনক করা সম্ভব। কেবল উৎপাদন বাড়ানোর মতো কিছু পদেক্ষপ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পাথরের বিশাল চাহিদার কারণে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের কাছে মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি নামে পরিচিত এ খনিটিতে এখন এক শিফটে শ্রমিক কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন ৩ শিফটে উৎপাদনে গেলে তা থেকে আয় বাড়বে এবং প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হবে। এছাড়া বর্তমান হারে উৎপাদন হলে সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেও খনিসূত্র জানিয়েছে।
তবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, খনিটিতে ৩ শিফটে উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুতে দেশীয় সম্পদ ব্যবহারের বিষয়ে সরকার আন্তরিক।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, সরকারের আন্তরিকতার কারণে চলতি বছরে খনিটির উৎপাদন বেড়েছে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে খনি পরিদর্শনে যাবেন জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে পাথর সরবরাহের ক্ষেত্রে আমরা এই খনির বিষয়ে সরকারের সক্রিয় বিবেচনা রয়েছে। এ জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়া খনিটি কোনো সময়েই মুনাফার দেখা পায়নি। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে লোকসান দিয়েছে ২৭ কোটি ২৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ২৩ কোটি ৩৩ লাখ ৬ হাজার টাকা, ২০১০-১১ অর্থ বছরে লোকসান দিয়েছে সর্বনিম্ন ৮ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
খনিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুতে ইগনিয়াস রক (২৪ হাজার পিএসআই) ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি ছাড়া এ মানের পাথর বাংলাদেশের আর কোথাও নেই।
তিনি দাবি করেন, খনিটি কোনো সময়েই মুনাফায় যেতে না পারার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে উত্তোলিত পাথর দিনের পর দিন অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকা।
পদ্মা সেতুতে বিশাল অংকের চাহিদা থাকায় পাথর পড়ে থাকার কোনো সুযোগ থাকছে না। সে কারণে খনিটির উন্নয়ন বাড়িয়ে পদ্মা সেতুতে পাথর সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে মুনাফায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সাবেক ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেন, এ জন্য প্রয়োজন এখন থেকেই কাজ শুরু করা। পদ্মা সেতুতে বিশাল অংকের পাথর প্রয়োজন হবে। তা সরবরাহ করতে গেলে বর্তমানে দিনে ১ শিফটে (সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা) পাথর উৎপাদন বাড়াতে হবে। ৩ শিফটে শ্রমিকদের উৎপাদনে নামাতে হবে।
মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দাবি করেন, এই মানের পাথর ভারতের উত্তরাঞ্চলে পাওয়া যায় না। আমদানি করতে হলে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হবে। আর যদি ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকেই পাথর আমদানি করতে হয়। তাহলে একই মানের পাথর আমদানি করতে খরচ পড়বে দ্বিগুণেরও বেশি।
তার মতে, ভারত থেকে আমদানি করতে হলে প্রতি টন পাথরে দাম পড়বে ৫৫ মার্কিন ডলারের বেশি। এর মধ্যে পরিবহন খরচ রয়েছে। আর দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যপাড়া খনিতে একই মানের পাথর পাওয়া যাবে মাত্র ২১ ডলারে।
খনিটিকে ৩ শিফটে নিতে পারলে উভয় দিক থেকেই সরকার লাভবান হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী আবুল বাসার বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুতে ৬০ মিলিয়ন টন পাথর প্রয়োজন পড়বে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিবছরে খনিটির ১ শিফটে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন। আর ৩ শিফটে কাজ শুরু করলে উৎপাদন হবে ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। পদ্মা সেতুর পাথর পুরোপুরি এই খনি থেকে সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তবে একটি বড় অংশ যদি সরবরাহ করা যায় তাহলে জাতীয় অর্থনীতির জন্য মঙ্গল হবে বলে তিনি মনে করেন।
৩ শিফটে উৎপাদন শুরু করার ব্যাপারে মধ্যপাড়া কঠিন শিলাখনি কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে একটি প্রস্তাব অনেক আগেই তৈরি করেছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আটকে আছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
উৎপাদিত পাথরের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ মে. টন পাথর অবিক্রীত পড়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবিক্রীত রয়েছে বড় (প্রস্থে ৮০ মিলিমিটারের ওপরে) আকৃতির পাথর (ভোল্টার বা ব্লক নামেও পরিচিত)। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাইড বাঁধের ভাঙন রোধ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। আর প্রস্থে ৫ মিলিমিটারের নিচে হলে সিমেন্ট তৈরির কাজে বেশি ব্যবহৃর হয়।
খনিটির বিশাল এলাকা জুড়ে এই দুই ধরনের পাথর পড়ে আছে। অভিযোগ রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এখান থেকে ভোল্টার না কিনে অন্য স্থান নেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপাড়া খনি থেকে পাউবোর জন্য ভোল্টার কেনা নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে পাউবোর দুর্নীতিও কমে যাবে।
বাংলাদেশ সময় : ০৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১২