ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

বন্দীশিবিরে দেড় মাস: নানাভাইয়ের জবানবন্দী থেকে

তানজীনা ইয়াসমিন, জাপান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
বন্দীশিবিরে দেড় মাস: নানাভাইয়ের জবানবন্দী থেকে

Tanjina[ জাপান প্রবাসী বিজ্ঞানী ও গবেষক তানজীনা ইয়াসমিন। তার নানাভাই (মাতামহ) অধ্যাপক ফজলুল করিম, একজন খ্যাতনামা শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিসংগ্রামী।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সিলেট ছিলেন এম.সি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। একই সংগে ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকায় মুক্তিকামী ছাত্রদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। সঙ্গত কারণে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর দেশীয় দালালদের চোখে পড়েন তিনি। ৭১ সালে দেড়মাসেরও বেশি সময় তিনি আটক ছিলেন পাকিস্তানি বন্দীশালায়। ওই সময়ের দুঃসহ স্মৃতি তিনি লিখে রেখেছিলেন। তার এই স্মৃতিকথনে উঠে এসেছে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন জ্বলন্ত চিত্র। টাইপরাইটারে ইংরেজিতে লেখা ওই স্মৃতিচিত্র বাংলানিউজের ‍পাঠকদের জন্য নিজের ভাষায় তুলে ধরেছেন তার গর্বিত দৌহিত্রী তানজীনা ইয়াসমিন। তিন পর্বে তা প্রকাশ হচ্ছে বাংলানিউজে। ]
 
আশৈশব স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে একই ধরনের আলোচনা, স্মৃতিচারণ, নাটক সিনেমা দেখে বেড়ে উঠতে উঠতে রক্তস্নাত ভূমিষ্টকাল ’৭১ এর প্রতি নাড়ির টানটা কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। যথোচিত আবেগটাও পানসে ঠেকে; সলজ্জ স্বীকারোক্তি- এ যেন ফিকে একটা বোধ।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের উদ্যোগে সমচিন্তার সহযোদ্ধা ও অনুগামীদের অক্লান্ত সংগ্রামের ফসল আমরা ৪২ বছর পর প্রথম যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর হবার মাধ্যমে দেখতে পেলাম। তবুও অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই বিচার প্রক্রিয়াকে, এমনকি এর প্রয়োজনীয়তাকেও।

শহীদ পরিবারদের স্বজন হারানোর ক্ষত তাতে আবারও রক্তাক্ত, আরো গভীরতর হচ্ছে । গভীর কষ্ট নিয়েই অনেকে বলেন, ‘মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে বলেই এতো কম সময়ে ৩০ লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগও আমরা ভুলে গেছি’!

আজ তাই কালের পুরানে বিস্মৃতপ্রায় নিজের মাতামহের বন্দীশিবিরের জবানবন্দী প্রকাশ করলাম। যারা সব দেখেও ভুলে গেছেন, আর যারা আমার মত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম, দেখেনি কিছুই, তাঁরা যেন একটু ’৭১ এ ফিরে যেতে পারে। মানতে শেখে কেন স্বাধীন বাংলায় ’৭১ আজীবন অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ’৭১ ভুলে গেলে সন্তান মায়ের প্রসব বেদনা ভুলে যাবে, মায়ের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ আর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে শুরু করবে।

শুরুতেই কিছু ভূমিকা আবশ্যক।

আমার মাতামহ, অধ্যাপক ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের উকিল বাবার ৯ সন্তানের পরিবারে প্রথম সন্তান হিসেবে; ৯ই জুন ১৯২৭ সনে। শুধু কৃতী ছাত্রই না –তিনি ছিলেন আমার দেখা একজন আদর্শ মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (’৪৬ থেকে ’৫০) রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরে দুটো পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েও জীবিকা হিসেবে শিক্ষকতার প্রতি অনুরক্ততায় বেছে নিলেন কলেজ শিক্ষকতা, কারণ তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেতন ঢের খানিকটা বেশি। এতে করে সংসারে ছোট ছোট ৮ ভাই বোনের প্রাণধারণের উপায় কিছুটা নিশ্চিত হয়।

আমার মাতামহের নিজ হাতে লেখা বন্দীশিবিরের জবানবন্দী প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কর্মস্থল (সহ- অধ্যক্ষ) চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের কলেজ ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’য় ১৯৭৩ সনে ( পৃষ্টা ৮৯- ৯৭) ।

প্রকাশিত সেই লেখা আর নানাভাইয়ের টাইপ রাইটারের ইংরেজি মুদ্রলিখন থেকে আমি নিজের ভাষায় বর্ণনা করছি।  

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন সিলেট এম.সি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, একই সংগে ছাত্র সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক। আবাসস্থল ছিল সিলেটের শেখঘাট সরকারি কলোনি। ২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের  ঘোষণার পর পরই সারা সিলেট শহরে সেনাবাহিনীর তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যায়। এ সময় সিলেট শহরের আশেপাশে ইপিআর, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালি জোয়ানদের নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। ছাত্ররা তাঁদের সাথে যোগ দেয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে আকাশে স্যাবর জেট দেখা যায়। বিমানগুলি পর পর কয়েকদিন শহরে ও এর আশেপাশে এয়ার স্ট্রাফিং করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিগুলো তাঁদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে বহু লোক হতাহত হয়। ৪ এপ্রিল হানাদার বাহিনী শহর ছেড়ে চলে যায় এবং সব সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র শালুটিকর বিমানবন্দরে কেন্দ্রীভূত করে। কিন্তু যাবার পথে তারা তদানীন্তন ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ৯ জন পুলিশ প্রহরীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। ঐদিন বেলা ১১টার সময় বিমান বাহিনীর ২টি বিমান গোটা শহরে ও আশেপাশে স্ট্রাফিং করে। বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তজায়গায় শেলিং করে।

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত সিলেট শহর মুক্তিযোদ্ধাদের অধীনে থাকে। ৮ই এপ্রিল ভোর সাড়ে আটটায় হানাদার বাহিনী পুনরায় শহর দখল করে। প্রথম দিকে হানাদার বাহিনী সংখ্যায় কম থাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রত্যহ পিআইএ প্লেনযোগে ৪/৫ বার করে ঢাকা থেকে সৈন্য এনে তারা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে। শহরে প্রবেশ করে তারা সাধারণ বাঙ্গালি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে আরম্ভ করে। কোর্টবিল্ডিং ও সার্কিট হাউসে আড্ডা গাড়ে। শহরের উপকন্ঠে শালুটিকরের নিকটস্থ আবাসিক মডেল স্কুলে ‘ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার’ এবং একটি বন্দীশিবির স্থাপন করে। তাছাড়া খাদিমনগরেও আরেকটি সামরিক ঘাঁটি করা হয়। এ সময় সুরমা নদীর দুই তীরে যত বাড়িঘড়, দোকানপাট ছিল তা পুড়িয়ে দেয়া হয় যাতে এসব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় না নিতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে চলে যায় এবং তাঁদের সঙ্গে শহরের তিন চতুর্থাংশ লোক গ্রামের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেয়। অনেকে সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়।

শেখঘাট সরকারি কলোনিতে বসবাসরত অস্থানীয় ছিল নানার পরিবারসহ মাত্র ৩টি পরিবার যারা বিবিধ কারণে শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য, কলোনিতে ৩৫টি বেসামরিক পরিবার ছাড়াও একজন সামরিক কর্মকর্তার পরিবার ছিল; পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন খলিল, নিঃসন্তান, যিনি তার স্ত্রী শিরিনকে ২৫শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের আগেই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন খলিল জানতেন আমার নানাভাই পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত লক্ষ্য এবং আমার নানাকেও শুভ্যানুধ্যায়ী তিনি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বাধ্য হয়ে তাঁর স্ত্রী’র লিখে যাওয়া ইংরেজি চিঠিও আমার নানীকে দেখিয়ে বলেছিলেন “ ভাবি, ভাইসাব চালে কিউ নেহি গ্যায়ে?” । ক্যাপ্টেন খলিলের স্ত্রী আমার মা, খালা- মামাদেরও অনেক আদর করতেন। তাই অনুনয় করে স্বামীকে লিখে গিয়েছিলেন তিনি যেন আমার নানার পরিবারকে দেখে রাখেন। ক্যাপ্টেন খলিল সেই অনুরোধ রেখেছিলেন।

কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে প্রায় প্রত্যেক ছাত্রের সঙ্গে মাতামহের হৃদ্যতা থাকায় শহর যখন হানাদার বাহিনীর কর্তৃত্বে ছিল তখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা প্রায়ই তাঁর খোঁজ নিতে আসতো। এটা দালালদের চোখে পড়ে যায়। স্থানীয় জাতীয় পরিষদের সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবের সাথেও অনেক দিনের বন্ধুত্ব। ছাত্রদের সেমিনার এবং বিশেষ বিশেষ দিবসে তিনি অংশ নিতেন।

এই প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিকতার বিবাদ এড়িয়ে একটি কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে, ছাত্রদের আনাগোনা ছাপিয়েও পাক বাহিনীর কাছে নানা’র লক্ষ্যবস্তু হবার প্রধান কারণ ছিল বঙ্গবন্ধু আমার মাতামহের আত্মীয়, বড় ভাই, ছিলেন। দুজনার বাবারই পেশা, কর্মক্ষেত্র ছিল একই। গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনেই তো এক সাথেই তাঁদের বেড়ে ওঠা – এক কাচারি ঘরেই পড়ালেখা, শৈশবের সাত রঙা সবরকম দুরন্তপনা। বঙ্গবন্ধু শেখঘাট কলোনিতে ‘৬৯ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে এবং ‘৭০ এ নির্বাচনে জয়ী হবার পরও কলোনি সংলগ্ন সাংসদ গাজী সাহেবের কর্মস্থল থেকে দেহরক্ষী মহিউদ্দীন সাহেবকে না নিয়ে একা নানার সাথে সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁকে দেখতে উপচে পড়া প্রতিবেশীদের ভীড় দালালদের নজরে এসে যায়। তাদের বিবেচনায় এটাই তাঁর মুখ্য দোষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।

পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করা ছাত্ররাও খুবই অনুনয় অনুরোধ করেছিলেন নানাভাইকে অন্যত্র চলে যাবার জন্য। এরইমধ্যে পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের তাণ্ডবে দেখা গেল শেখঘাট কলোনির পেছনে সিলেটের বিশিষ্ট সমাজসেবী, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিমলেন্দু দাস সাধু বাবুর বিশাল এলাকা জুড়ে আবাসস্থল, পেছনের বড় বাজার- সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে সরাসরি দূরের সুরমা নদী দৃশ্যমান ! উল্লেখ্য, সাধুবাবু তৎকালীন সিলেটের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ২টি সিনেমা হলের মালিক ছিলেন;  নিজের ব্যবসার কাজের ট্রাক, গাড়ি দিয়ে তিনি সিলেটের বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পার করেছিলেন।

কারফিউ চলাকালীন সিলেটের তৎকালীন একমাত্র মসজিদ, যেখানে মাইক ছিল, ‘কাজীর বাজার মসজিদ’র ইমামকে আজান দেয়ার ‘দোষে’ সেই অবস্থায় হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।