ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

কেন চৈতন্যমেলা: কী ছিল লক্ষ্য

সুব্রত কুমার দাস, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৬
কেন চৈতন্যমেলা: কী ছিল লক্ষ্য চৈতন্যমেলার উদ্বোধন করছেন ড. দিলীপ চক্রবর্তী

প্রথমেই বলে রাখি শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) নিয়ে নতুন করে আমার আগ্রহের শুরু ২০১৫ সালের ১৫ মে। সে আগ্রহ ব্যাপ্তি লাভ করে আমাকে দিয়ে ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ নামে একটি গ্রন্থ লিখিয়ে নিয়েছে।

অনেক বই পড়তে পড়তে এবং বই লিখতে লিখতে মহান এই যুগপুরুষের ব্যাপারে আমি এতো উৎসাহিত বোধ করতে থাকি যে তাঁর দর্শন ও শিক্ষা, ইতিহাসে তাঁর অবস্থান এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের বিষয়টিকে আরও বেশি করে প্রচারের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে শুরু করি। আগ্রহী বন্ধুরা সবাই মিলে গত ১২ মার্চ টরন্টোতে চৈতন্যমেলার আয়োজন করেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে এমন একটি আয়োজন কমিউনিটির অধিকাংশ মানুষকে যে তৃপ্ত করেছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এতো বড়ো একটা আয়োজনের পেছনে অনেকের অবদান থাকে, সম্পৃক্তি থাকে, থাকে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা। আজকে সেইসব নিয়ে লিখতে বসেছি।

‘শ্রীচৈতন্যদেব’ শিরোনামে গ্রন্থ লেখার পেছনের কথা নিয়ে অন্যত্র লিখেছি বিধায় এখানে আর পুনরুক্তি করছি না। তাছাড়া সে-প্রসঙ্গ অনেকটাই আমার ব্যক্তিগতও বটে। যদিও আমি খুব ভালো করে বুঝি প্রকাশিত লেখা কখনই লেখকের ব্যক্তিগত থাকে না; তার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যান আমাদের সমাজের মানুষেরা। অতীত নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিকোণের স্পর্শ থাকে সে সবের মধ্যে। তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ‘শ্রীচৈতন্যদেব’ বইটা লিখতে গিয়ে চৈতন্যদেব নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের ভাবনা মাথায় আসা এবং সবাইকে নিয়ে সেটি সম্পন্ন সম্ভব করে তোলা।  

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইনের শুভেচ্ছাবার্তা প্রদান করছেন এমপিপি দীপিকা ডামেরলা এবং এমপিপি আর্থার পটস। আয়োজকদের পক্ষে গ্রহণ করছেন অসীম ভৌমিক।

মোটামুটি তিনমাস ধরে চৈতন্যমেলার আয়োজন চলেছে। এর বেশির ভাগ সময় কয়েকজন বন্ধুকে খুব বেশি করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। তাঁদের ভাবনা আমাকে বুঝতে সাহায্য করছিল যে আমরা সঠিক পথেই আছি। প্রথম জন হলেন সুমু হক। চৈতন্যদেব নিয়ে বক্তৃতা করতে বলাতে যিনি সহাস্যে রাজি হয়েছিলেন, যদিও পরে সেটা করতে পারেননি শারিরীকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়াতে। দ্বিতীয় জন হলেন বিশিষ্ট চিত্রী ও লেখক সৈয়দ ইকবাল। গত ডিসেম্বরের শেষে রবীন্দ্রনাথ-ইয়েটস নিয়ে আয়োজিত আমাদের এক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। চৈতন্যমেলার আয়োজনের কথা জেনে তিনি ভীষণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। গুণী এই মানুষটির সেদিনকার মুখপ্রভা এখনও আমি হৃদয়ে ধারণ করি। এছাড়াও প্রত্যক্ষভাবে অপরিচিত আশিস বড়ুয়ার কাছে আমি ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলাম আমার ভাবনার কথা। বলেছিলাম আমরা চাই সকল ধর্মের মানুষেরা কথা বলুন। তিনি বিশিষ্ট বৌদ্ধ পণ্ডিত ভান্তে শরণপালার সাথে আমাকে যোগোযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। আরও একজন হলেন সাদী আহমেদ। সাদীভাই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগ্রহী। কিন্তু একদিন ব্যক্তিগত আলাপে তিনি বলেছিলেন বাঙালির সংগীতে বর্তমানের প্রধান যে যন্ত্র সেই হারমোনিয়াম নিয়ে চৈতন্যসংশ্লিষ্টতার কথা। হাসান মাহমুদ বা পামেলিয়া খালেদ বা আলিমুন হায়দারীও ইতিবাচক কথা বলে আমার মনোবল বাড়িয়েছেন। কারণ, তাঁরা সুস্পষ্ট ভাষায় আমাকে বলেছেন চৈতন্যদেবকে হিন্দু হিসেবে দেখা হীনমন্যতা। তাঁকে বড়ো মাপের একজন মানুষ হিসেবে দেখতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা। এদের কথা শুরুতে বলে নিলাম কারণ তাঁদের কথা আমাকে বুঝিয়েছিল আমি সঠিক পথেই আছি।

অনুষ্ঠানের ঘোষণা হতেই দেখা গেল টরন্টোর সাপ্তাহিক পত্রিকা বাংলা কাগজ, বাংলা মেইল, ভোরের আলো, দেশের আলো এবং মাসিক প্রবাসী কণ্ঠ সে ঘোষণার প্রেস রিলিজ ছাপল মর্যাদার সাথে। ঢাকায় বাংলানিউজসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা ও দৈনিকও সে প্রেস রিলিজ ছাপল গুরুত্ব দিয়ে। আয়োজকদের মনে উৎসাহ যোগান দিল সেসব সংবাদ প্রকাশনা। স্পষ্ট হলো পথ ভুল হয়নি।  

উপস্থিত সুধীবৃন্দের একাংশ

চৈতন্যদেব নিয়ে বইটা লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক ঋদ্ধ হয়েছি। এবং সেটা হতে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে এই যে আমার ব্যক্তিগত উন্নয়ন সেটাকে অন্য বন্ধুদের সাথে সহভাগ করলে কেমন হয়? ক’জনই বা আমার বই পড়বেন? তাছাড়া বইতো বলা যায় শুধু আমার ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব নিয়ে আরও অনেকের ভাবনাকে জানতে, তাঁকে নিয়ে সাংস্কৃতিক যে ব্যাপকতা সেটিকে সবার সামনে তুলে ধরতে, তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে উৎসাহী মানুষদের মনোভাবনাকে প্রকাশ করতে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে মূল্যায়ন করতে দরকার বোধ করেছি একটি আয়োজনের যেটিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ সম্পৃক্ত হবেন।

একটা জিনিস অনেকের মতো আমিও মনে করি, ধর্ম-প্রাসঙ্গিকতায় সব কিছুকে যদি আমরা দূরে ঠেলে রাখি তাহলে তো জ্ঞানগ্রন্থ হিসেবে বেদ-উপনিষদ আমাদের ত্রিসীমানায় আনতে পারবো না। সাহিত্য হিসেবে রামায়ণ-মহাভারত থাকবে দূর অবস্থানে। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে অবাঙালি পশ্চিমা মানুষ কাজ করলে, বই লিখলে তাঁদেরকে আমরা অভিধা দেই ‘প্রাচ্যবিদ’। তাঁদেরকে আমরা সম্মান দেই ‘গবেষক’ হিসেবে। আর বাঙালি কেউ সে পথে গেলে আমরা সমালোচনা করি। মজার বিষয় হলো, যে  বন্ধুরা এই আয়োজনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের অনেকেই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে খুব আগ্রহী নন। বরং উৎসাহী ধর্মের দর্শন নিয়ে। সামগ্রিক বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা নিয়ে। সেই লক্ষ্য থেকেই চৈতন্যমেলাতে তাঁদের সম্পৃক্তি। তারপরেও কমিউনিটির মানুষদের সমালোচনার সম্ভাবনায় আশঙ্কিত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু স্বস্তির যে, তাঁরা অহেতুক তেমন সমালোচনার ভয়ে পিছিয়ে পড়েন নাই। আর তাই, আয়োজক সকল বন্ধুকে তাঁদের সাহসিকতার জন্যে অভিবাদন জানাই।

আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, উপনিষদের চর্চা করেছিলেন বলে কি আমরা মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা এখন রবীন্দ্রনাথকে পরিত্যাগ করবো? অথবা লালনের মতো দার্শনিক ‘জগাই মাধাই দুটি ভাই/ কান্দা ফেলে মারলে গায়,/ তারে তো নিলে’ বলেছিলেন বলে কি আমার লালনকে ত্যাগ করবো?। অথবা কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি ‘বর্ণচোরা ঠাকুর এল রসের নদীয়ায়,- তোরা দেখবি যদি আয়’ এর মতো শত শত গান লিখেছেন বলে তাঁকে আমরা পরিত্যাগ করবো কি না। এমন সব খড়্গ-প্রশ্ন মাথায় নিয়েই আয়োজকদের ‘চৈতন্যমেলা’ করার উদ্যোগ নেওয়া এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। চৈতন্যমেলা হয়েছিল বলেই না এইসব কম-জানা সব বিষয়গুলো ক্রমে ক্রমে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠলো!

পুস্তক প্রদর্শনীতে বোদ্ধাজনেরা

চৈতন্যদেবের সাথে বাঙালির যে সাংস্কৃতিক সংযোগ, সাংগীতিক সম্পর্ক, সাহিত্যিক যোগসূত্র তা সময়ের ভুলের কারণেই মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না? আমাদের সংস্কৃতির এমন অনুরূপ আরও বহু উপাদান আছে যেগুলোর সাথে ধর্মের সংযোগ খুব বেশি। আমি যদি নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ মনে করি, আর তাই সত্যকে প্রকাশে পিছুপা হতে পছন্দ করি না। আর তাই চৈতন্য নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করাকে আমরা সকলে একটি দায়িত্ব বলেই মনে করেছি।

এই যে উচ্চশিরধারী শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে একটা বড়োসড়ো আয়োজনের ভাবনা সেটা মাথাতে আসতেই শুরু হলো নিকটজনদের সাথে আলাপ। ড. দিলীপ চক্রবর্তী, আকবর হোসেন, সুজিত কুসুম পাল নির্ভয় মানসিক বল দিলেন। বুঝতে পারলাম অনুচিত কাজ করছি না। শুরু হলো বাস্তবায়নের ভাবনা। এক সন্ধ্যায় ম্যাকডোনাল্ডস-এ কফি খেতে খেতে কথাটা উঠলো মানিক চন্দ এবং অমল পালের সাথে। বুঝতে পারলাম এই দুজন মানুষ সে ভাবনাকে পছন্দ করছেন। তাঁদের দুজনের বেশি ভালো লাগার কারণ হলো আমি ব্যাপারটাকে প্রচলিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে ভাবছি। চৈতন্যদেবকে ইতিহাসের বিচারে তুলে আনার ব্যাপারে আমার উদ্যম ওই দুজনের ইতিবাচক স্নেহদৃষ্টি পেতেই শুরু করলাম আরও অনেক কাছের জনদের সাথে আলাপ-আলোচনা। আশ্বাস পেলাম অলোক চৌধুরী-গোপা চৌধুরী দম্পতির কাছ থেকে। এগিয়ে  এলেন পণ্ডিত প্রসেনজীৎ দেওঘরীয়া, সুশীতল সিংহ চৌধুরী, অসীম ভৌমিক। ক্রমে যুক্ত হয়ে গেলেন শ্যামল ভট্টাচার্য, রায় নিখিলেশ, প্রতিমা সরকার, জয়া দত্ত সেনাপতি, বিপ্লব সোম, চিত্ত ভৌমিক, অনূপ সেনগুপ্তসহ আরও কতো কতো জন।

যখন প্রোগ্রাম পরিকল্পনা করা হলো, আলোচনায় অংশ নিতে রাজী হলেন টরন্টো বেদান্ত সোসাইটির স্বামী কৃপাময়ানন্দ, টরন্টো ইসকন থেকে পাঠানো হলো প্রতিনিধি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে অনুষ্ঠানকে মূল্যবান করতে এগিয়ে এলেন অরুণাভ ভট্টাচার্য, চয়ন দাস, সজীব চৌধুরী, অজয় বণিক, স্নিগ্ধা চৌধুরী, কল্যানীয়া পুরবীসহ আরও কতো কতো জন।

খুবই আনন্দের যে, টরন্টোর বিচেস-ইস্ট ইয়র্ক এলাকার এমপি নাথানিয়েল এরসকিন-স্মিথ আসতে সম্মত হলেন। আয়োজকদের পক্ষে অন্টারিও-র প্রিমিয়রকে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিনিধি হিসেবে পাঠালেন বিচেস-ইস্ট ইয়র্ক-এর এলাকার এমপিপি আর্থার পটস এবং মিসিসাগা ইস্ট-কুকসভিল এলাকার এমপিপি দীপিকা ডামেরলাকে।

চৈতন্যদেব বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন বিচেস-ইস্ট ইয়র্ক এলাকার এমপি নাথানিয়েল এরসকিন-স্মিথ

বই লিখতে গিয়ে শুধু যে একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময় থেকে ঠিক পাঁচশো বছর আগে শ্রীচৈতন্যদেবের যুগান্তকারী কর্মকাণ্ডের কাল সম্পর্কে জেনেছি তা নয়। সামান্য হলেও বুঝতে পেরেছি ষোড়শ শতাব্দীর পুরো দ্বিতীয় দশক জুড়ে সমগ্র বাংলাদেশ অঞ্চল ছাড়িয়ে সে বাঙালি যুগপুরুষের মানবতার বাণী কেন ভারতবর্ষের দূর দূর প্রান্তেও পৌঁছেছিল কোটি কোটি মানুষের কাছে। বাংলাদেশের সিলেট জেলাতে যে চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষের জন্ম তিনি কিন্তু এমন একজন বাঙালি যাঁর ব্যাপক কর্মযজ্ঞের আয়োজন অসত্য প্রমাণ করেছিল সেই আপ্তবাক্যটি ‘বাঙালিরা সংঘবদ্ধ হয়ে কিছু করতে পারে না’। তাছাড়া শ্রীচৈতন্যদেবের কর্মকাণ্ডের ফলেই বাংলাভাষায় বিপুল পরিমাণ সাহিত্য রচিত হয়। আর তাই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বহু জায়গাতেই তাঁর নাম দার্শনিক সক্রেটিসের নামের সাথে সাথে উচ্চারিত হতে দেখি। চল্লিশ বছরের জীবনে তিনি বাংলাতে একটি লাইনও না লিখলেও তাঁকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি যুগ। ২০০ বছর ব্যাপী সে যুগটি ১৫০০ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত। তাঁর উদ্যোগেই বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রথম নাটক অভিনীত হয়। সংস্কৃত ভাষায় নাটক রচনার এবং অভিনয়ের যে ধারা ভারতবর্ষে দুই হাজার বছরের বেশি পুরনো, সেটিকে বাংলা ভাষায়, বাঙালির দর্শনে জনগণের সামনে উপস্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে শ্রীচৈতন্যদেবের ভূমিকা যে কোনো বাঙালির কাছে নমস্য। বাঙালি অঞ্চলে নৃত্যের আজকে যে বিকাশ তারও উদ্যোক্তা হিসেবে শ্রীচৈতন্যের নাম সর্বাগ্রে আসবে। তিনিই বঙ্গীয় অঞ্চলে সর্বপ্রথম সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন- নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন সকলকে সমমর্যাদা দিয়ে। যৌথনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি যে যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন সেটি ছিল একক নেতৃত্বের মুখে বিশাল এক চপেটাঘাতের মতো ছিল। যৌথ নেতৃত্ব ব্যবহার করে তিনি নেতৃত্ব গুণ এবং দক্ষতার চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েছিলেন। আর সে গুণ এবং দক্ষতার কারণেই প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষীয় অঞ্চলে তিনিই সফল হতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রীয় শক্তিকে জনশক্তির কাছে অবনত করতে।

তিনি যে সামাজিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটির মূল সূত্র কী? সে সূত্রের মুলমন্ত্র কী ছিল যা পুরো বাঙালি সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল? সে মন্ত্রের মধ্যে কী এমন আধুনিকতা ছিল যা দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে প্রধান শহরগুলোতে শ্রীচৈতন্যদেব পূজিত হয়ে থাকেন? বাংলা অঞ্চলের বাইরে, অথবা ভারতবর্ষীয় অঞ্চলেরও বাইরে লক্ষ লক্ষ অবাঙালি, অহিন্দু গভীর শ্রদ্ধায় নত অন্যতম যে বাঙালি ব্যক্তিত্বের কর্ম ও জীবনপদ্ধতির প্রতি তিনি তো শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি আমাদের সিলেট বা নবদ্বীপের মানুষ। তাঁকে নিয়ে চর্চা করলে তো আমরা নিজেরাই ধন্য হই!

এটি সকলের জানা যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠিন নিগরে একসময় ভারতবর্ষীয় সমাজ নিমজ্জমান ছিল। তখন ঈশ্বরজ্ঞান বা ঈশ্বর-আরাধনা প্রধান লক্ষ্য না হয়ে সে-সমাজের উদ্দীষ্ট হয়ে দাঁড়ায় তাদের আরাধনার আচার। সংস্কারাচ্ছন্ন সে-আচারে পিষ্ট হতে থাকে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট সমাজের নিচু জাতির কোটি কোটি মানুষ। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট উঁচুতলার মোড়লগিরিতে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে মানবতা। সুদূরবাসী ঈশ্বরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলমান যে আচারসর্বস্বতা তাঁর বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন যে মানুষটি তিনি বাঙালি সন্তান গৌরাঙ্গ যাঁর আরেক নাম নিমাই। সন্ন্যাস পরবর্তী সময়ে তিনি নাম নেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তাঁর সে হুঙ্কারে এতই তেজস্বিতা ছিল যে তিনি অবতার হিসেবে আদৃত হতে শুরু করলেন। গত পাঁচশো বছর ধরে বাঙালি সেই মহামানব ‘ঈশ্বরের অবতার’ হিসেবেই পূজিত।

ভক্ত কীর্তনিয়াবৃন্দ
শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষা কী? প্রধান শিক্ষা হলো: ‘তৃণাদপী সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা। / অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ’ অর্থাৎ তৃণ অপেক্ষাও অতিশয় নীচ হয়ে, বৃক্ষ অপেক্ষাও সহিষ্ণু হয়ে, নিজে অমানী হয়ে, অপরকে মান দান করে হরিনাম কীর্তন করা কর্তব্য। ঈশ্বর আরাধনার এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় কী? বিনয়ের এমন যে অবতার সেই মহামানবকে নিয়েই আমাদের সকলের আয়োজন ছিল টরন্টো চৈতন্যমেলা। তাঁকে জানতে, তাঁর দর্শনকে বুঝতে, তাঁকে আশ্রিত সংগীতকে অনুভব করতে, তাঁর ওপরে বিশাল যে গবেষণা সে বিষয়ে আলোকপাত করতেই ছিল আমাদের চৈতন্যমেলা।

সে মেলা সফল হয়েছে শত শত শুভানুধ্যায়ীর আশীর্বাদে। বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দিরের কর্তাবৃন্দের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এমন একটি আয়োজনের সাফল্য ছিল সুদূর পরাহত। অজয় দাস, শিবু চৌধুরি, নির্মল কর, বিজিত রায়, সুভাষ রায়ের মতো নিবেদিতপ্রাণ নেতারা চৈতন্যমেলার কাজকে তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব ভেবেছেন বলেই আমাদের উদ্যোগটি দর্শক-শ্রোতাদের প্রশংসা পেয়েছে। অভিজিত পাল দিনরাত খেঁটে পুরো অডিটোরিয়াম সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে আমাদের কাজকে সহজ করে দিয়েছেন। কীর্তনের দল নিয়ে এগিয়ে এলেন মিন্টু পাল, শরদিন্দু দে, রুক্ষ্মিনীদাদার মতো ভক্তবৃন্দ। অনুষ্ঠান শুরুর সামান্য আগে প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্প্রতি চালু এনআরবি টেলিভিশনের পক্ষে শহীদুল ইসলাম মিন্টু যখন জানালেন তাঁরা পুরো অনুষ্ঠানটি ধারণ করতে চান, তখন যেন সব মেঘ সরে সূর্য হেসে উঠলো। আর অদ্ভুত এই যে, মার্চের এমন দিনে যখনে টরন্টো বরফে ঢাকা থাকে, চৈতন্যমেলার দিন ঝকঝকে রোদ থাকলো সারাদিন আর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের সময় তাপমাত্রা অবিশ্বাস্যভাবে ১৭ ডিগ্রিতে উঠে এলো।

এটি আমাদের অজানা নয় যে তেমন আরও শত শত ভালোবাসার মানুষ পাশে ছিলেন বলেই এমন অভিনব একটি আয়োজন সার্থক হয়েছে। আমরা আশাবাদী এই সার্থকতা নতুন সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দেবে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে।  

লেখকের ই-মেইল: subratakdas@yahoo.com ওয়েবসাইট: http://bdnovels.org/

বাংলাদেশ সময়: ০৪০৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৬
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।