ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

জাপানিদের অনুকরণ করলে বিশ্বজয় সম্ভব

তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
জাপানিদের অনুকরণ করলে বিশ্বজয় সম্ভব ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জাপান থেকে ফিরে: জাপানে অনেক বিষয় আছে আমাদের বিস্মিত করার মতো। চারদিন ছিলাম।

টোকিও থেকে কাশিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে গেলাম। রাস্তাঘাট, হোটেল, মোটেল, স্টেশনে আমাদের মতো বিপুলসংখ্যক পুলিশ দেখিনি। কারণ তারা এতটাই সভ্য যে, চোর-পুলিশ খেলার প্রয়োজন হয় না। ভদ্র আর বিনয়ী মানুষগুলো পুলিশকে বেকার বানিয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। পুলিশ দেখেছিলাম বিমানবন্দরে, তা-ও হাতে গোনা কয়েকজন।

জাপানি বিমানবন্দর, বিশেষ করে নারিতা বিমানবন্দরের কথাই বলি। এত দ্রুত ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শেষ হতে পারে কল্পনারও অতীত। মার্জিত ভাষায় দু-একটি প্রশ্নতেই তারা আস্থা রাখেন অতিথিদের ওপর। চেকিং করার সময়ও অত্যন্ত ভদ্র ভাষা একমাত্র জাপানেই হয়তো পাবেন। হয়রানির বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তাদের স্বভাবে নেই। সাবাস জাপান।

লাল-সবুজের বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে জাপানের যেমন নকশাগত বৃত্তের মিল আছে। তেমনি সবুজের সমারোহেও। প্রাকৃতিক সবুজের পাশাপাশি কৃত্রিম সবুজের ছড়াছড়ি মুগ্ধ করবে অতিথিদের। টোকিওর বাইরে গেলাম। বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত।

আমাদের জমিতে যেমন আল তাদেরও আছে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে পার্থক্য হলো, তাদের জমিতে আসা-যাওয়ার জন্যে পাকা সড়ক আছে। যে সড়ক দিয়ে চাষাবাদের আধুনিক উপকরণ, যন্ত্রপাতি যেমন নেওয়া হচ্ছে তেমনি আবার উৎপাদিত পণ্যও নিয়ে আসা যায় অনায়াসে। বিলের পাশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ছোট ছোট সেমিপাকা বাড়ি।

দেয়াল পাকা, টিনের ছাউনি। যেখানে সূর্যরশ্মি থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা চোখে পড়লো। আমাদের গাইড জানালেন, চার দশক আগেও জাপানে কায়িক পরিশ্রমে মাঠে কৃষি কাজ হতো। এখন সবই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে বীজবপন, ধান রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, সার ছিটানো, ধান কাটা, মাড়াই সবই মেশিনে।

জাপান ভ্রমণে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি, ঘরে-বাইরে সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়। আমাদের মতো মোড়ে মোড়ে উন্মুক্ত ডাস্টবিন, দুর্গন্ধ যেমন নেই তেমনি ছেলে-বুড়ো সবাই সচেতন। হয়তো কঠোর নজরদারি এবং দণ্ড আছে যত্রতত্র ময়লা ফেলার বিষয়ে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, নিট অ্যান্ড ক্লিন বলতে যা বোঝায় জাপান তা-ই। বাংলাদেশ থেকে যারা সফরসঙ্গী ছিলেন, সবাই বিষয়টি উপভোগ করেছেন। একজন মজা করে বললেন, এদেশে তো ঘরে-বাইরে এমনকি গাড়ির চাকাতেও বালু খুঁজে পাওয়া যাবে না! আসলেই তা-ই, বৃষ্টির সময় কাদাও লেগে থাকে না চাকায়।

আমাদের দলে ছিলেন প্রথম আলোর বিশ্বজিৎ চৌধুরী, একুশে টেলিভিশনের রফিকুল বাহার, দৈনিক পূর্বকোণের কলিম সরওয়ার, বৈশাখী টেলিভিশনের মহসিন চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাকের সালাউদ্দিন মো. রেজা, সময় টেলিভিশনের কমল দে, দৈনিক আজাদীর সবুর শুভ, কালের কণ্ঠের শিমুল নজরুল, বণিক বার্তার রাশেদ এইচ চৌধুরী, এটিএন বাংলার ভানু রঞ্জন চক্রবর্তী, ক্যামেরা পারসন শহীদুল ইসলাম, আমাদের সময়ের হুমায়ুন কবীর খোকন, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং পিএইচপি পরিবারের মি. ইদ্রিস, জামাল ও দিলশাদ।

গাড়ির দেশ জাপান। টয়োটা, মিৎসুবিশিসহ বিশ্বখ্যাত অনেক ব্রান্ডের কারখানা এদেশে। বিশ্বের গাড়ির চাহিদার বড় একটি অংশ মেটাচ্ছে জাপান।

বাংলাদেশে বেশিরভাগ ‍রিকন্ডিশন্ড গাড়িই জাপানের। রো-রো জাহাজে চড়ে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হয়ে এসব গাড়ি পৌঁছে শো-রুমে। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ১৫ হাজারের বেশি গাড়ি আমদানি করেছে বাংলাদেশ। শুধু মার্চেই এসেছে দুই হাজার ৪৩৮টি গাড়ি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গাড়ি আমদানি হয়েছিল ১৭ হাজার।

বলছিলাম, জাপানে ব্রান্ড নিউ গাড়ির শো-রুমগুলো ছড়িয়ে আছে। দামও সস্তা। আমাদের মতো তাদের তো আর জাহাজভাড়া, উচ্চহারে শুল্ক দিতে হয় না। কিন্তু গাড়ি ব্যবহারে সক্ষম হলেও তারা অনেকেই গাড়ি কেনেন না। কারণ গাড়ি রাখার জন্যে যে পার্কিং ভাড়া তার দাম বেশি। মাসে ৩০-৪০ হাজার ইয়েন। একেতো মিতব্যয়ী জাপানিরা। তার ওপর ট্রেন-নির্ভর তাদের জীবনযাত্রা। আছে গণপরিবহনও। সব মিলে বেশ ভালোই কাটছে তাদের জীবন।

আশাহি গ্লাস কোম্পানির (এজিসি) মার্কেটিং ম্যানেজার (স্ট্যাটেজি) সোহেই কুরিহারা বাংলানিউজকে জানান, টোকিওতে এজিসির করপোরেট অফিস থেকে এক ঘণ্টার ট্রেন-ভ্রমণের দূরত্বে থাকেন তিনি। প্রতিদিনই আসা-যাওয়ায় মিলে ৪০০ কিলোমিটারের বেশি পাড়ি দেন তিনি। ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা ও পরিচালনার মতো সক্ষমতা তার আছে। কিন্তু কিনছেন না পার্কিং রেট আর অনভ্যস্ততার কারণে। নিজের গাড়ি নেই তাতে তার এতটুকু আফসোস নেই। বরং স্বস্তির খুশি চোখেমুখে।

আকাশ-পাতাল তফাৎ কি সেটা বোঝা যায় জাপানের হ্যাকুনি মাউন্টেনে। যার উচ্চতা ১ হাজার ৩২৭ মিটার। উচ্চতার বিষয় বলছি না।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় যখন আপনি ক্যাবল কারে যাত্রা শুরু করবেন। সব শেষে গিয়ে পড়বেন যেখানে তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রিতে। হিমশীতল ঠান্ডা আপনাকে কাবু করবেই। অবশ্য, ফায়ার প্লেস আর আগুন পোহানোর মাধ্যমে শীত তাড়ানোর ব্যবস্থাও আছে ওপাড়ে। সত্যিই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। মনে হবে হঠাৎ ভিনগ্রহে চলে এসেছেন আপনি। জাপানের শীর্ষ পর্বত ফুজি মাউন্টেন, উচ্চতা ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার বা ১২ হাজার ৩৮৮ ফুট। এ দুটি পর্বত যেন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, টোকিও স্কাইট্রি। যেটি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শুধু কি পর্যটক, জাপানের স্কুল শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের সঙ্গে বেড়াতে আসছে সেখানে।

একেকজন স্কুলছাত্র মানে একেকজন দেবদূত। বড়দের চেয়ে তারা আরও বেশি বিনয়ী, আরও বেশি ভদ্র। তাদের দেখেও মুগ্ধ হতে হয়। শৃঙ্খলাসহ অনেক কিছু শিখতে হয়। বিশেষ করে, তারা পিকনিক করার সময় চকলেট, চিপস, মুখরোচক হালকা খাবার যে খায় না তা নয় কিন্তু মোড়ক, উচ্ছিষ্ট কিছুই নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া ফেলে না। এ ধরনের অভ্যাস বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে গড়ে উঠছে, অনেক স্কুলে-অনুষ্ঠানে আপনার চোখে পড়েছেও। কিন্তু আমাদের বড়রাই যেখানে অসচেতন সেখানে ছোটদের এ শিক্ষা-অভ্যাস খুব বেশি প্রভাব ফেলছে না।    

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অন্যরকম একটি তীর্থস্থান দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। কাশিমা শরিনি নামের প্যাগোডা দেখতে যেদিন আমরা যাই সেদিন এত বৃষ্টি পড়ছিল যে ‘ক্যাটস অ্যান্ড ডগ’র কথাটিই মনে হচ্ছিল। জবুথবু আমরা। কিন্তু মুগ্ধ হলাম প্যাগোডার একটি অংশ দেখে।

যেখানে একটি নির্দিষ্ট কাঠের সেলফে মানত করে ভক্তরা ‍কাগজে নিজেদের নাম লিখে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। তাদের বিশ্বাস, এর ফলে মানত বা মনের আশা পূর্ণ হবে। আমাদের দেশেও অনেক মাজারে, তীর্থ স্থানে নিয়ত করে সূতা বেঁধে দেওয়ার প্রচলন আছে। সে কথাই মনে পড়ে গেল। এটিও হয়তো জাপানিদের সঙ্গে আমাদের মিলই বলা চলে।

ভূমিকম্প আর সুনামির দেশ জাপান গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস পণ্যে বিশ্বজয় করেছে। তাদের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে সেগুলো যদি আমরা অনুকরণ করতে পারি তবে আমরাও বিশ্বজয় করতে পারবো। এ তালিকায় আমি রাখবো জাপানিদের টনটনে সময়জ্ঞান, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা, সর্বজনীন ভদ্রতা আর সত্যিকারের বিনয়।       

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
টিসি

**জাপানি কর্মকর্তা বাংলায় বললেন, ‘কেমন আছেন?’

**টোকিও স্কাইট্রি, ফুজি-হাকুনি মাউন্টেনে মুগ্ধ পর্যটক

** জাপানিদের উন্নতির মূলমন্ত্র ‘সময় জ্ঞান’
** ভূমিকম্পেও বিকার নেই জাপানিদের

** জাপানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি

**জাপানিরা বলছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা উজ্জ্বল

**জাপান সফরে যাচ্ছেন বাংলানিউজের তপন চক্রবর্তী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।