ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

মেঘের ভেলায় চড়ে দেখা ইস্তাম্বুলের দুর্লভ চিত্র

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৬ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
মেঘের ভেলায় চড়ে দেখা ইস্তাম্বুলের দুর্লভ চিত্র ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্ট (তুরস্ক) থেকে: স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় রানওয়ে স্পর্শ করে টিকে- ৭১৩ প্লেনটি। ল্যান্ডিংয়ের আগে অনেকটা নিচ দিয়ে বসফরাস প্রণালী ও মারমারা উপ-সাগরের উপরে চললো চক্কর।



ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে উড়ে এসে ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে অর্থাৎ, দক্ষিণ-পূর্বমুখী রানওয়ে ছুঁয়ে ল্যান্ড করে টার্কিশ এয়ারের ফ্লাইটটি।

ইস্তাম্বুলের আকাশে তখন সাদা মেঘের ভেলা। মাথার উপর সোনালি রোদ। এটা নাকি ইস্তাম্বুলের দুর্লভ চিত্র। পাশের সিটে বসা তেহরানের বাসিন্দা জানালেন বিষয়টি। তিনি নাকি অনেকবার ইস্তাম্বুল এসেছেন। প্রতিবারেই দেখেছেন মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টি ঝরতে।

সোনালি রোদের কারণে চকচক করছিল মেঘের ভেলা। ঠিক যেনো ধুনাই করা শেষে তুলা স্তূপ করে রাখা হয়েছে লেপ-তোষক তৈরির জন্য। টিলার সারির মতো দেখাচ্ছিলো সেই সাদা মেঘের ঘনঘটা।

নিচে নীল সাগরে সি-বাস ও নৌকার সারি মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায় যাত্রীদের মধ্যে। দূরে সুউচ্চ ভবন দৃশ্যমান। বিমানবন্দরের কাছাকাছি দ্বিতল ভবনগুলোতে টালির ছাউনি। দেখতে অনেকটা দোচালা ঘরের মতো।

সবার দৃষ্টি তখন প্লেনের জানালায় নিবদ্ধ। অনেকেই মোবাইল ফোনে দৃশ্য ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জানালায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আরও যুতসই কারণ রয়েছে। প্লেনটির ২৪৩ জন যাত্রীর মধ্যে বেশিরভাগেই ইস্তাম্বুলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছেন। যারা ইস্তাম্বুলে নেমে অন্য ফ্লাইট ধরে গন্তব্যে যাবেন। এ গন্তব্যের তালিকায় রয়েছে রোম, জার্মানি, তেহরান, মস্কোসহ বিভিন্ন শহর। তাদের কাউকে কাউকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য।

ঐতিহাসিক এ শহরে পা রাখছেন কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন না। যে কারণে প্লেন থেকেই চোখ জুড়িয়ে নিতে চাইছিলেন অনেকে। ঠিক যেনো দুধের সাধ ঘোলে মেটানো।

ঢাকার শাহজালাল ইন্টারন্যাশনালের চেয়ে বোধহয় চারগুণ বড় হবে এয়ারপোর্টটি। বিশ্বের ব্যস্ততম এয়ারপোর্টের তালিকায় এগারোতম। আর ইউরোপেরে মধ্যে হিথ্রো ও প্যারিসের পরেই এর অবস্থান। ঘণ্টায় ৬০টি প্লেন ওঠানামা করে। আর বছরে এ এয়ারপোর্টটির যাত্রী হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা রয়েছে ৬০ মিলিয়ন।

আর শাহজালালে ঘণ্টায় ১০টি ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। বছরে ১৫ মিলিয়ন যাত্রী হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি রয়েছে এর। যদিও ২০১৪ সালে ৬ মিলিয়ন যাত্রী এয়ারপোর্টটি ব্যবহার করে বলে পরিসংখ্যানে দেখা যায়।

ইস্তাম্বুলে প্রতি মিনিটে প্লেন ওঠা-নামা করায় সবসময় যাত্রীর পদচারণায় মুখর থাকে এয়ারপোর্টটি। কে কোন দিকে ছুটছেন তার ঠিক নেই। আবার অনেকে ট্রানজিট টাইমে ক্যাফে ও বারে বসে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন।

বিশাল বড় টার্মিনালে সারি সারি দোকান। কি নেই তাতে! জুয়েলারি থেকে মনোহরি, কাপড় থেকে ফাস্টফুড, কসমেটিকস সবই হাতের নাগালে। শপিংমলের মতো দুই পাশে লাইন করে বসানো হয়েছে দোকানগুলো। তবে কাপড়ের দামটা বেশ চড়াই মনে হলো। সাধারণ মানের একটি ফুলপ্যান্ট বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার টাকা হাঁকালেন বিক্রেতা।

১৯২৪ সালে যাত্রা করা এই এয়ারপোর্টটির ২৭টি বোডিং ব্রিজ রয়েছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এয়ারপোর্টটির দোকানগুলো ছাড়া আর কোথায় বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলতে দেখা গেলো না। ছাদে এমনভাবে প্লাস্টিকের টিন স্থাপন করা হয়েছে। যাতে কয়েক হাজার ভোল্টের মতো আলো দিচ্ছিলো। দোকানগুলোতে যে আলো রয়েছে তাও সীমিত পরিসরে।  

বোডিং ব্রিজের মুখে যাত্রী ওয়েটিং রুমগুলোও কাচ দিয়ে ঘেরা। সেখানে বৈদ্যুতিক বাতির কোনো বালাই নেই। এখানে ইঞ্জিনচালিত হুইলচেয়ারের সঙ্গে সাক্ষা‍ৎ। বয়স্ক ও অসুস্থ যাত্রীদের চেয়ারে বসিয়ে তার পেছনে পাদানিতে ভর করে দাঁড়িয়ে পড়ছে বাহক। আর সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে ইঞ্জিনচালিত হুইলচেয়ার।

বেশ পরিপাটি মনে হলো এয়ারপোর্টটি। টার্মিনাল যেমন পরিচ্ছন্ন তেমনি রানওয়ের পাশেও ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো। আর ঘাসগুলো পার্কের মতো ছেঁটে সাজানো। ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল সিটি থেকে ২৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এয়ারপোর্টটি।

এর উত্তরে মারমারা উপসাগর যুক্ত কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে। দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। ভূমধ্যসাগর ও মারমারা উপসাগরকে যুক্ত করেছে বসফরাস প্রণালী। এই প্রণালী জ্বালানি তেল সরবরাহ, রাশিয়া ও ইউক্রেনে যাতায়াতের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জ্বালানি তেলের পাশাপাশি ভূ-রাজনীতির কারণেও বসফরাস প্রণালী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রণালীর দখল নিতে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। ১৮৭৭-৭৮ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে। যুদ্ধ বিগ্রহ থামাতে চুক্তিও হয়েছে বেশ কয়েকটি।

১৯২০ সালে সেইভিস চুক্তি হয়। তাতে বলা হয় বসফরাস প্রণালী থাকবে সামরিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত। এরপর ১৯৩৪ সালে লিউসিন চুক্তি করা হয়। লিউসিন চুক্তিতে বলা হয় এই প্রণালী দিয়ে সব দেশের নৌযান নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে। তবে তুরস্ক লিউসিন চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৩৬ সালে মনটিক্স কনভেনশনে বলা হয়, কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের দেশের নৌযান ছাড়া অন্য দেশের নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তুরস্ক।

বসফরাস প্রণালীর উপর তুরস্ক চারটি ঝুলন্ত সেতু স্থাপন করে আঙ্কারার সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্লেন থেকে দেখা ঝুলন্ত ব্রিজগুলো জাদুর মতো আকর্ষণ করছিলো যাত্রীদের। বসফরাসকে এশিয়া-ইউরোপের সীমারেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দৈর্ঘ্য ৩১ কিলোমিটার, প্রস্থে ৩৪২০ মিটার থেকে সর্বোনিম্ন ৭শ মিটার রয়েছে। গভীরতা ১৩ থেকে ১১০ মিটার।

এর চারদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা ও বিভিন্ন সময় ইস্তাম্বুলকে শাসনকারী রাজাদের প্রাসাদ। তারা শুধু প্রাসাদ স্থাপন করেই খ্যান্ত দেননি, তাদের খেয়াল-খুশিতে প্রায় সাতবার নাম পরিবর্তন হয় শহরটির। যথাক্রমে এ শহরের নাম বাইজেন্টিয়াম, কনস্টান্টিনোপল, কনস্টান্টিপোলিস, স্টিম্পল, এস্তানবুল হয়ে সর্বশেষ ইস্তানবুল ধারণ করেছে।

ইস্তাম্বুলে ট্রানজিট ফ্লাইট থাকলে আগেভাগে ভিসা নিয়ে রাখলে ওয়াটার বাস, সিটিবাস, ট্যাক্সি সার্ভিস নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন পরিপাটি এ ঐতিহাসিক শহরটি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৫১৩ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
এসআই/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।