ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

আত্মহত্যার স্বাদ নিতে প্রস্তুত?

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৬
আত্মহত্যার স্বাদ নিতে প্রস্তুত? ছবি: জিএম মুুজবুর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পোখারা, নেপাল থেকে: এটার স্বপ্ন দেখে, জয় করে এবং করে বারবার। আর এটাই হচ্ছে আত্মহত্যার অভিজ্ঞতা নেওয়া বাঞ্জি জাম্প।

৭০ মিটার উঁচু থেকে নিজেকে শূন্যে ছাড়িয়ে দেওয়া।

যেখানে ৩ সেকেন্ডের জন্য নির্বিঘ্নে পড়ে যাওয়া। যা দেবে সত্যিকারের অাত্মহত্যার অভিজ্ঞতা ও স্বাদ। তবে কেউ এখানে কাউকে ডেকে অানেননি। অার জাম্পের আগেই পোখারায় হাইগ্রাউন্ড অফিসে স্বাক্ষর করে অাসা হয়েছে, ‘যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। বরং আমিই মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবো’। প্রথমবারের মতো পেটে মোচড় দিল।

বেশ দক্ষ কোচ ক্রু নেপালি সেরিনাত। আমাদের একসঙ্গে যাওয়া অাটজনকে প্রথমেই চোখ মুখ টিপে হাসি দিয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম টু হেল, হোয়্যার ইউ কাম ফর সুইসাইড’।

কলিজার ভেতর দ্বিতীয়বারের মতো মোচড় দিয়ে উঠলো।

আটজনের দলটিতে আমরা দুই বাংলাদেশি ছাড়াও তিন চায়নিজ তরুণী, এক পাকিস্তানি তরুণী এবং একজন নেপালি তরুণী। উচ্চতায় লম্বা বিবেচনায় ভ্রমণসঙ্গী আনোয়ার ভাইকেই প্রথম জাম্পার হিসেবে বেছে নেওয়া হলো। এরপর এক চায়নিজ ও পাকিস্তানি তরুণীর পরই অামার টার্ন নির্দিষ্ট করা হয়।

এর আগে কোমড়, কাঁধ ও দুই পায়ে বাঁধা সিকিউরিটি বেল্ট পরান অারেক ক্রু অমিত। দ্বিতীয়বারের মতো সেগুলো যাচাই করা হয়।

সেরিনাত শেখান, ‘লাফ দেওয়ার সময় নিজের সাহসে না কুলালে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য বলতে হবে। হাঁটু ভাজ করা যাবে না। আগে মাথা এবং বুক নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সাঁতারের মতো পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই লাফ দিতে হবে’।

এটা নেপালের একমাত্র টাওয়ার জাম্প। টাওয়ার ধরে সেরিনাতের পেছন পেছন চললাম আটজনের দল।

পিচ্ছিল টাওয়ারে পা ফেলতে হচ্ছিল বেশ সন্তর্পণে। এরপর জাম্পের জন্য টাওয়ারের চূড়ায়। নিচে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী। পাহাড়ের কোল থেকে বের হয়ে অাসা এ টাওয়ারের চূড়া থেকে নিচে তাকালে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তবে এখন আর ভয় পেলেও পেছানোর পথ নেই। অার সেটা যদি হয় ৪ ভিনদেশি তরুণীর সামনে, তাহলেতো মৃত্যুকে ভয় পাওয়া কাপুরুষ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

লাফ দেওয়ার আগে সকলকে আবারো বলা হয়, ‘আপনারা আত্মহত্যার অনুভূতি নিতে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোজখকে দেখতে পাবেন। সত্যিকারের অাত্মহত্যার স্বাদ পাবেন ও তাকে জয় করবেন’।

এখানে লাফ দেওয়া কাউকে অপেক্ষমান কেউ টাওয়ার থেকে দেখতে পান না। আমরা সকলেই কথা বলে নিজেদের চাঙ্গা রাখতে চাইছিলাম।

আনোয়ার ভাই লাফ দেওয়ার সময় পেছনে ঠেলে রাখছিলেন শরীর। অামরা বাকি সাতজন তাকে দেখছিলাম আর গলায় ঢোঁক গিলছিলাম। তাকে ফ্রি করতে কিছুটা সময় নিলেন কোচ। এরপর তার অনুমতি নিয়ে পেছন থেকে ধাক্কা দিলেন কোচ। আমাদের বাকি সাতজনের মধ্যে পিন-পতন নীরবতা।

নীরবতা ভাঙতে পাকিস্তানের তরুণী ভেরসা কাজীর কাছে জানতে চাই, তিনি কি করেন? একটি এনজিও'র প্রধান হিসেবে কাজ করেন করাচিতে। এখানে নিজের একা জীবনটাই উপভোগ করতে এসেছেন।
ভেরেসার পরই আমার টার্ন। এর মধ্যে সকলেই অাবার অট্টহাসিতে ভয় কাটাতে চাইছিলাম।

যখন দু'পা ছড়িয়ে কিনারে দাঁড়ালাম, বুঝলাম আর সত্যিই ফেরার উপায় নেই। মাথার হেলমেটে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভয়ের মুখে ভেংচি কাঁটলাম।

রেসিনাত আগেই বলেছিলেন, চিন্তাকে শূন্যে নিয়ে যেতে। তাই করলাম, তবে তাকেই পেছন থেকে ধাক্কা দিতে বললাম। কারণ, তিনি যখন জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি নিজে লাফ দেবে?’ নিজের শরীরটাকে বোধহীন মনে হচ্ছিল।

পরের তিন সেকেন্ডে বুকে একটু চাপ, চারদিকে পাহাড় আর জীবনের সব অ্যালবাম আওড়ানো হয়ে গেলো। যখন দড়ির টান অনুভব করলাম, বুঝতে পারলাম, আমি মারা যাইনি। গলা ছেড়ে চিৎকারের শুরু। নিচ থেকে ক্রু চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, ‘শান্ত হও, শান্ত হও’।

আমি শান্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু দ্রুতগতির সঙ্গে ঘুরছিল দড়ি, অামাকে পেন্ডুলামের মতো ওলট-পালট করে ঘোরাচ্ছিল।

নৌকায় নামার পর পাড়ে দেখলাম, আনোয়ার ভাই দাঁড়িয়ে অাছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন লাগলো?’ উত্তর, ‘আপনার মতোই’।

এই আত্মহত্যার অনুভূতি ও স্বাদ পেতে আর ভয়কে জয় করতে প্রতিদিন পোখারার ২০ মিটার দূরে হামজায় চলে আসেন কয়েকশ’ পর্যটক।

নেপালের পোখারায় দ্য লাস্ট রিসোর্ট এবং হাইগ্রাউন্ড দেয় বাঞ্জি জাম্পের স্বাদ। খরচ পড়ে বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৪ হাজার টাকার মতো।

তবে যাদের উচ্চতাভীতি এবং হৃদরোগজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৬
এমএন/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।