মেয়েটির প্রবাস জীবনের ঝুলির অভ্যন্তরে রয়ে যাওয়া স্মৃতিরা প্রায়শই উঁকি দেয়, নাড়া দেয়। মেয়েটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরাও আছি, আমরাও নিতে চাই মুঠোভরা উন্মুক্ত নিঃশ্বাস।
মানুষের জীবন যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, স্মৃতির ক্যানভাস হয় বিশাল। রং-তুলির একেকটি আঁচড়, একেকটি স্মৃতি। এই ভাষার মাসে তেমন কিছু স্মৃতি, কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু উপলব্ধি, কিছু প্রশ্ন এবং উত্তরের খোঁজে রয়েছে মেয়েটি।
প্রবাসে বাংলা শেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক এখন কমে এসেছে। নিউ ইয়র্কে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টি-চর্চার প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের শিকড় সম্পর্কে এখন জানতে চায়। এজন্য নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি মাধ্যম তারা বেছে নিয়েছে। এর সাহায্যে তারা জানতে ও বুঝতে শিখছে মাতৃভূমিকে।
তবে, নিউ ইয়র্ক শহরে এই চর্চাগুলো কিছুদিন আগেও ভালোভাবে গ্রহণ করেননি অনেকে। এমন এক সময় ছিল যখন মেয়েটির মাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন মেয়েকে বাংলা না শিখিয়ে অন্য কোনো ভাষা শেখাতে। তবে তিনি এসব কথায় কান দেননি। মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন গীতবিতান, সঞ্চিতা, হাজার বছরের বাংলা ইতিহাস, বাংলা ব্যাকরণসহ অসংখ্য বাংলা বই। স্বল্পভাষী বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে দেন, এটিই সঠিক সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে সেই মেয়েটি মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত শিশু-কিশোর মেলার দায়িত্ব পালন করছে। মেয়েটি নতুন প্রজন্মের যে তরুণ-তরুণীদের নিয়ে মেলার আয়োজন করছে তাদের সঙ্গে বয়সের সর্বোচ্চ ব্যবধান পনেরো বছর। তারা প্রত্যেকেই মেয়েটির প্রজন্ম। তার মতো ঠিক একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারাও। যেখানে তাদের অভিভাবকদের অনেকেই মাতৃভাষা চর্চাকে বাঁকা চোখে দেখছেন। মেয়েটি বিস্ময়ভরে তাদের কথা শোনে আর হাজার প্রশ্নের ঘূর্ণিঝড়ে দোলায়মান নিজেকে সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে নিজেইতো বিবেক-বিবেচনাহীন অগ্রজদের আচরণে বিতৃষ্ণ। নিজেকে সে প্রশ্ন করে- নতুন প্রজন্ম কি এ কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে?
কিন্তু আগামী প্রজন্মই বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাবে। ওদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে বাংলার ইতিহাস, বাঙালিত্বের গৌরব। ওরা লালন করবে বাংলাকে, ওদের মন ও মননে সজীব থাকবে বাংলা- এই তো প্রত্যাশা।
তাদের মধ্যে এই চেতনা জাগাবে তাদের অভিভাবকরা, তাদের অগ্রজরা। তাদের কাঁধেই এই ভার। অথচ তারাই ‘নেতিবাচক’ আচরণের কথা ভেবে তরুণদের শিকড় থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। এখন সময় এসেছে অগ্রজদের পরিবর্তনের। তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে অগ্রজ প্রজন্মের ভাবনা, উচ্চারণ ও আচরণের বদল এখন অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে যাদের ছেলেমেয়ে প্রবাসে বেড়ে উঠছে, সেই অভিভাবকদের সন্তানকে শিকড়ের সন্ধান দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। হয়তো তরুণেরা এখন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করবে না তবে এক সময় গিয়ে এর গুরুত্ব তারা অবশ্যই বুঝবে। হাতের মুঠোয় গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত পৃথিবী তারই বার্তা দিচ্ছে।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে পরিস্থিতি ও আচরণের শিকার মেয়েটি। তার পড়া মূল্যবান একটি উক্তি ‘Be the change you wish to see in this world.’ তার জীবনকে বদলে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের মতো করে মতবিনিময় করতে পারবে তার জন্য একটি জায়গা তৈরির জন্য সে অঙ্গীকারাবদ্ধ। যেখানে তাদের চিন্তা-ভাবনা আদান-প্রদান করতে পারবে, তাদের মতামত প্রাধান্য পাবে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বছরে একটি দিন হলেও তারা নিজেরাই হবে আয়োজক, কর্মী ও শিল্পী। তাদের ওনারশিপ ও লিডারশিপে দক্ষতার পরিচয় মিলবে। শিশু-কিশোরদের মিলনমেলার এই স্বপ্ন সঙ্গী করে মেয়েটি অগ্রসর হচ্ছে।
খুব অল্প বয়সে না চাওয়া সত্ত্বেও মেয়েটি চিনতে, শিখতে পেরেছে তার চারপাশকে। সিক্ত হয়েছে অপ্রত্যাশিত অসাধারণ কিছু মানুষের ভালোবাসায়। এটিই তার শক্তি। বাস্তব জীবনে তাদের কাছে পাওয়া শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে হার না মানতে, শিখিয়েছে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে। সেই শক্তিই এখন সে দেখতে চায় নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর মধ্যে।
নতুন প্রজন্মের লড়াই তাদের সত্য, সুন্দর ও স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করবার। শুধু আলো দিয়েই সম্ভব অন্ধকারকে ঘুঁচিয়ে ইতিবাচক স্থাপনা গড়ার। তবেই সত্যিকারের সৌন্দর্য ও সাফল্য অর্জিত হবে। বাংলা উজ্জীবিত থাকবে, বাঙালি হবে গৌরবোজ্জ্বল, বাংলা ও বাঙালি হবে বিজয়ী।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮
আরআর/এএ