ঢাকা: যাত্রাশিল্পী পরিচয়ে তারা গর্বিত। হওয়ারই কথা! রাতভর মানুষকে তারা আবিষ্ট করে রাখতেন ঐতিহাসিক গল্প আর লোক কাহিনিভিত্তিক পালায়।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐহিত্য যাত্রাপালা। কিন্তু আমাদের গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে আজ বিলুপ্তির পথে এই শিল্প। দুর্গাপূজা এবং শীতকাল হচ্ছে যাত্রাপালার ভরা মৌসুম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই ভরা মৌসুমেও যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা অভাবেই বিনোদনের জনপ্রিয় এই মাধ্যমটি আজ ঝুঁকির মধ্যে। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন যাত্রাশিল্পে পেশাগত নিশ্চয়তা কাটেনি এ বছরেও।
বছরের শেষ এই সময়টাতে এসে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসনের অনীহা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতি মেলেনি। ফলে বছরজুড়ে পেশাদার যাত্রাদল মালিক ও শিল্পীরা ছিলেন হতাশা ও অনিশ্চয়তায়। যাত্রার এই আকালের সময় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১০০টি পালা মঞ্চায়নের উদ্যোগ- আয়োজন যাত্রা অঙ্গনে বিপুল উৎসাহ সঞ্চার করে। বিভিন্ন যাত্রাদল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের পরিবেশনায় একাডেমির নির্বাচিত পালাগুলো বিভিন্ন স্থানে এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়িত হয়। তবে যাত্রাশিল্পের প্রতি প্রশাসনও ছিল বিরূপ।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১০০টি পালা মঞ্চায়নের উদ্যোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রাপালা পরিবেশিত হয়েছে। এর মধ্যে শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব প্রযোজনা মাসুম রেজা রচিত নিঃসঙ্গ লড়াই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিসর্জন, দেশ অপেরার বঙ্গবন্ধুর ডাকে, চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, জয়যাত্রার এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জাহারাবি রিপন রচিত তেজগাঁও কলেজের রাজিয়া সুলতান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোর প্রাণে যাই, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন ভাই, লোক নাট্যগোষ্ঠীর বাংলার বীর ঈশা খাঁ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, নেত্রকোনা ও মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দেশীয় পালা মঞ্চস্থ করে কোহিনুর অপেরা, ব্রহ্মপুত্র যাত্রা ইউনিট, সিজার্স যাত্রা ইউনিট, আনন্দ অপেরা, রং মহল অপেরা, রংধনু অপেরা, স্বদেশ অপেরা, চৈতালী অপেরা প্রভৃতি পেশাদার যাত্রাদল।
অন্যদিকে যাত্রাশিল্পের প্রতি বিরূপ প্রভাব ছিল প্রশাসনের। দু’একটি জেলা ছাড়া কোথাও পালা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের। তাদের মতে- বরগুনা ও নড়াইল জেলায় বার বার আবেদন নিবেদন করার পরেও যাত্রা করার অনুমতি মেলেনি। শিল্পকলা একাডেমির ১শ যাত্রাপালার আয়োজন দল মালিক ও শিল্পীদের যেমন স্বস্তি দিয়েছে, তেমনি অনুমতি সমস্যার কারণে বাইরে স্বাধীনভাবে যাত্রা করতে না পারার দুঃখ কষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে বছরটি শেষ হচ্ছে।
এছাড়া এবছর যাত্রাশিল্পে প্রয়াত হয়েছেন বিখ্যাত বিবেক গায়ক গৌরাঙ্গ আদিত্য, সংগঠক-অভিনেতা রাজ্জাক গোঁসাই, সোনা মিয়া ও মন্টু মিয়া। আর ১১ নভেম্বর যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন যথাক্রমে বিশিষ্ট যাত্রানট ও গবেষক মিলন কান্তি দে এবং অভিনেতা-নির্দেশক এম আলীম।
যাত্রা শিল্পের সার্বিক অবস্থা নিয়ে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মিলন কান্তি দে বলেন, করোনার আগে থেকেই যাত্রাশিল্প নাজুক অবস্থায় ছিল। এখন তাদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দরকার। সেটা শুধু মুখে বললে হবে না, শিল্পকলা একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু প্রণোদনা গত বছর যাত্রাশিল্পীরা পেয়েছিলেন বটে, তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির যাত্রাপালার আয়োজন দল মালিক ও শিল্পীদের যেমন স্বস্তি দিয়েছে, তেমনি অনুমতি সমস্যার কারণে দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে বছরটি। এসব বিষয়ে সরকারে আরও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তবেই যাত্রাশিল্পীরা বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২২
এইচএমএস/এএটি