ঢাকা: অনেকটা স্থবির রাজনৈতিক অঙ্গন বিদায়ী বছরের শেষ কয়েক মাসে অনেকটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে দেশে তৈরি হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার।
এছাড়াও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাক্ষ্য দিতে আদালতে আগমন, জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা নিয়েও সরগরম ছিল আদালত। অন্যদিকে রাজনৈতিক ডামাডোলে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তৈরি হয় উৎকণ্ঠার।
সম্রাটের জামিনকে ঘিরে কৌতূহল
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের জামিনকে ঘিরে আদালত অঙ্গনে এক ধরনের কৌতূহল তৈরি হয়। তার বিরুদ্ধে হওয়া চার মামলার তিনটিতে হঠাৎ জামিন পান। সবশেষ অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের এক মামলায় একবার জামিন পাওয়া এবং সেই জামিন বাতিলে কৌতূহল বাড়ে।
দুদকের মামলায় গত ১১ মে প্রথম দফায় সম্রাটের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান। ওই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর গত ১৮ মে সম্রাটের জামিন বাতিল করে আদেশ দেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদেশে সম্রাটকে সাতদিনের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী সম্রাট গত ২৪ মে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আদালত জামিন শুনানি না করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর গত ২২ আগস্ট এই মামলায় ফের জামিন পেয়ে মুক্তি পান তিনি।
সাক্ষ্য দিতে আদালতে সজীব ওয়াজেদ জয়
লন্ডনে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যাচেষ্টা মামলায় সাক্ষ্য দিতে গত ১৩ নভেম্বর আদালতে আসেন জয়। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আসাদুজ্জামান নুরের আদালতে এই মামলায় সাক্ষ্য দেন তিনি। জয়ের আদালতে আগমন উপলক্ষে ঢাকার সিএমএম আদালতে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। এই মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক শফিক রেহমান, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ ৫ জন।
জি এম কাদেরের দলীয় কার্যক্রমে আদালতের নিষেধাজ্ঞা
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় যাবতীয় কার্যক্রমে দায়িত্ব পালনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন ঢাকার একটি দেওয়ানি আদালত। দলটির বহিষ্কৃত নেতা দলটির সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।
একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞার আদেশে সৃষ্টি হয় কৌতূহল। জি এম কাদেরের পক্ষ থেকেও আইনি লড়াইয়ে নামেন তার আইনজীবীরা। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে করা হয় আবেদন। তবে কয়েক দফা শুনানি শেষে গত ১৬ নভেম্বর তার নিষেধাজ্ঞার আদেশ বহাল রাখেন আদালত।
জঙ্গি ছিনতাই: আদালতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। গত ২০ নভেম্বর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অষ্টম তলায় সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা শেষে ওই ভবনের নিচে ফটকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বাইরে থাকা সহযোগীরা আসামিদের নিতে যাওয়া পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় আদালতের সামনে রাস্তা পার হয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
পালিয়ে যাওয়া দুই আসামি হলেন—সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুরের মইনুল হাসান শামীম ও লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার ভেটশ্বর গ্রামের আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। মইনুল হাসান দীপন হত্যা মামলার এবং আবু সিদ্দিক সোহেল দীপন ও অভিজিত হত্যা উভয় মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। যে মামলায় মোট আসামি ২০ জন। যার মধ্যে ৬ জন পলাতক, দুজন জামিনে ও ১২ জন জেলহাজতে ছিলেন। সেই ১২ জনকে জেলহাজত থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা দুজনও আদালতে হাজির ছিলেন। জেলহাজতে থাকা ১২ আসামির মধ্যে ছিনতাই হওয়া দুজনসহ মোট চারজনকে একত্রে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।
এই ঘটনায় সারা দেশে তাৎক্ষণিক রেড এলার্ট জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাৎক্ষণিকভাবে বেশ কয়েকজনকে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তত সন্দেহে গ্রেফতার করলেও পালিয়ে যাওয়া দুই আসামি এখনো রয়েছে অধরা।
একদিনে বিএনপির সাড়ে চারশ’ নেতাকর্মী আদালতে
ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেই ঘটনায় পল্টন, মতিঝিল ও শাহজাহানপুর থানার পৃথক তিন মামলায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও এর আশপাশ থেকে গ্রেফতার প্রায় পাঁচশ’ নেতাকর্মীকে ৮ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করা হয়।
এর মধ্যে ছিলেন—বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আ. ছালাম, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, যুগ্ম মহাসচিব খাইরুল কবীরর খোকন, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস প্রমুখ।
একদিনে এত বিপুলসংখ্যক দলীয় নেতাকর্মীকে আদালতে হাজির করাকে কেন্দ্র করে আদালত অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। দিনভর আইনজীবীরা মিছিল স্লোগানে মুখর ছিল ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য আদালতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন।
কারাগারে ফখরুল-আব্বাস
আগের দিন প্রায় পাঁচশ’ নেতাকর্মী হাজির করাকে ঘিরে আদালতে উত্তাপের পরদিনই বিএনপির অপর দুই শীর্ষ নেতা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন তাদের আদালতে নেওয়া হলে ফের উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে ৯ ডিসেম্বর তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। তারা এখনো কারাগারেই আছেন।
জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে জামায়াত আমিরের রিমান্ড
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. মো. শফিকুর রহমানকে গত ১৩ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। একই মামলায় শফিকুরের ছেলে ডা. রাফাত চৌধুরীকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। ছেলেকে জঙ্গি কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে গত ১৩ ডিসেম্বর ৭ দিন ও ২১ ডিসেম্বর ফের তিনদিনের রিমান্ডে নেয় সিটিটিসি। জামায়াত আমিরকে আদালতে আনা উপলক্ষে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। পুলিশের সঙ্গে সোয়াট টিমও আসে নিরাপত্তা দিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০২২
কেআই/এমজেএফ