স্বাস্থ্য বিভাগের ফার্মাসিস্ট পদে জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির সাবেক সিভিল সার্জনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার আসামিরা হলেন সেই সময়ের নিয়োগ বোর্ডের আহ্বায়ক তৎকালীন জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বীর কিশোর চাকমা অটল, তৎকালীন সিভিল সার্জন নারায়ন চন্দ্র দাশ, রাঙামাটির বর্তমান সিভিল সার্জন ড. শহীদ তালুকদার, জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রিয় কুমার চাকমা, উদয়ন চাকমা ও সুমন চাকমা।
রামগড়ের পাকলা পাড়া এলাকা থেকে ৪ মার্চ মারমা ঐক্য পরিষদ নেতা চাইথুই মারমাকে অপহরণ করা হয়। ঘটনার জন্য ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করে মাঠ পর্যায়ে পাহাড়ি বাঙালির সম্মিলিত আন্দোলন ছিল বছরের আলোচিত ঘটনা।
খাগড়াছড়ি জেলা সদরের মিলনপুর ব্রিজ এলাকায় গত বছরের ২৪ মার্চ দুর্বৃত্তদের ছুকিকাঘাতে মো. রাসেল (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়। সে ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানা যায়। সে সময় এ ঘটনার জন্য পৌর মেয়র রফিকুল আলমের অনুসারীদের দায়ী করা হয়। এ নিয়ে মেয়র সমর্থক ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
মহালছড়ির মাইছড়ি এলাকায় গত ১৬ এপ্রিল কাঠ কিনতে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ হন কাঠ ব্যবসায়ী মাটিরাঙ্গার নতুন পাড়া এলাকার খোরশেদ আলমের ছেলে মো. সালাউদ্দিন (২৮), একই এলাকার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মহরম আলী (২৭) ও আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা ট্রাক চালকবাহার মিয়া। এখনও তাদের খোঁজ মেলেনি। ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন টানা মিছিল সমাবেশ ও হরতাল কর্মসূচি পালন করে।
খাগড়াছড়িতে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ মামলায় গেল ১৯ এপ্রিল ৩ যুবককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। সেইসঙ্গে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন দীঘিনালা উপজেলার বাছা মেরুং এলাকার মো. মর্তুজা আলীর ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন (২৭), একই এলাকার মৃত আক্কাছ আলীর ছেলে মো. ফারুক হোসেন (২৭) ও বড় মেরুং এলাকার ইসহাক মিয়ার ছেলে ইমন হোসেন (২৫)। ২০১৪ সালে দীঘিনালার বাছা মেরুং এলাকায় কিশোরীকে গণধর্ষণ করা হয়।
খাগড়াছড়িতে ১৫ জেএমবি সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ২৩ এপ্রিল। একজনকে দেওয়া হয় খালাস। ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ১৩ বছর পর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং জেলা ও দায়রা জজ রত্নেশ্বর ভট্টাচার্যী এই রায় ঘোষণা করেন।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর হত্যাকাণ্ড। ৪ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় যাওয়ার পথে রাঙ্গামাটির নানিয়ারের বেতছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ একাংশের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহত হন আটজন। ঘটনাটি রাঙ্গামাটি এলাকায় ঘটলেও তার প্রভাব পড়ে খাগড়াছড়িতেও।
গত ২০ মে থেকে পানছড়ি বাজারে উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিক্রি করতে কিংবা কিনতে পাহাড়িরা আসতে পারছে না। সাপ্তাহিক হাট বাজার থাকছে ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ)র বাঁধার কারণে পাহাড়িরা বাজারে আসতে পারছে না।
খাগড়াছড়ির জেলা পরিষদ পার্কে ২১ জুন দুপুরে সংঘবদ্ধ বখাটে যুবক এক কিশোরীকে (১৫) গণধর্ষণ করে। এ ঘটনায় আটজনকে আসামি করে মামলা করে ওই কিশোরী। ওই মামলায় আসামিদের আটক করে পুলিশ।
বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চঞ্চু মণি চাকমাকে অপহরণের চেষ্টা। ১৩ জুলাই দুপুরে শহরের কোর্ট বিল্ডিং এলাকা থেকে সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চঞ্চু মণি চাকমাকে অহরণের চেষ্টা করা হয়। অপহরণ করতে না পেরে হত্যার লক্ষ্যে ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে এখনও আড়ালে থাকছেন চঞ্চু মণি চাকমা।
এক নারীকে খুনের ঘটনায় ২৪ জুলাই মো. শহীদুল ইসলাম নামে এক যুবককে (৩১) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বাস স্টেশন এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভবনে ফেরদৌসি আক্তার (৩১) নামে এক নারীকে গলা টিপে হত্যা করা হয়।
শোকের ঘটনাও ঘটেছে ২০১৮ সালে। ২৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কল্প রঞ্জন চাকমা (৯৮) মারা যান। তিনি ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে দুই দফায় খাগড়াছড়ি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হলে তাকে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশ-বিদেশে বিক্ষোভ হয়েছে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী কৃত্তিকা ত্রিপুরা ওরফে পুনাতি(১১) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। ২৯ জুলাই দীঘিনালার নয় মাইল নামক এলাকা থেকে পুনাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ঘটনায় খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মানুষ। বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ পালন করা হয়। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে।
সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে ২০১৮ সালের ৭ হত্যাকাণ্ড। ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির জেলা সদরের স্বনির্ভর এলাকায় ছয়জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর সদরের পেরাছড়া এলাকায় গ্রামবাসীদের নিয়ে ইউপিডিএফ একটি মিছিল বের করলে সেখানে সন্ত্রাসীরা হামলা করে। এসময় হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে আরও একজন মারা যান। ঘটনাটি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খাগড়াছড়িতে বছরজুড়ে ছিল খুন, গোলাগুলি, অপহরণ, ধর্ষণের মতো আরও বেশ কিছু ঘটনা। যা স্থানীয়দের শঙ্কিত করে তোলে। সবার প্রত্যাশা হিংসা ও হানাহানি ভুলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানে যেন সবাই বসবাস করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯
এডি/আরআর