বছরের শুরুতেই রাজধানীর চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৭১ জন। আবাসিক এলাকায় ঘনবসতির সরু গলিপথে অবস্থিত কেমিক্যাল গোডাউন যখন আলোচনায়, তখনই সুসজ্জিত আধুনিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ১১ মাসে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ১৩৮ জন ও আহতের হয়েছেন ১৪ হাজার ৯৩২ জন। হিসেবের বাইরে বছরের শেষে ডিসেম্বরে কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানা ও গাজীপুরের ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান আরও ৩২ জন। এর মধ্য দিয়ে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অনিয়ন্ত্রিত কারখানার চিত্র ফুটে ওঠে আরেকবার।
চকবাজারে কেমিক্যাল অভিশাপে অঙ্গার ৭১ জন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে একদিকে সমগ্র জাতি যখন ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, আরেকদিকে কেমিক্যালের আগুনে পুড়ছিল চকবাজার। এ রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট রাতভর চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান ৬৬ জন এবং আহত হন অনেকে। উদ্ধার করা আহত ও দগ্ধদের মধ্যে পরে আরও পাঁচ জন মারা যান।
ওয়াহেদ ম্যানশনে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে চোখের পলকে, ঘটে মর্মান্তিক প্রাণহানি। এ বিষয়ে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে ওই ঘটনায় নিহত জুম্মনের ছেলে আসিফ বাদী হয়ে ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলেসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় মামলা করেন।
এ মামলায় গত ২ এপ্রিল ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ওরফে শহীদ ও হাসান আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর ৮ এপ্রিল এ দুই আসামির সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত ১৬ এপ্রিল রিমান্ড শেষে দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকাবাসীর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ছিল এ চকবাজার ট্র্যাজেডি। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেমিক্যালের কারণেই চকবাজার আগুনের ভয়াবহতা এবং প্রাণহানি বাড়ে। এরপর সংশ্লিষ্ট সব নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এক হয়ে পুরান ঢাকা থেকে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল উচ্ছেদ অভিযানে নামে। তবে ক’দিন পর কর্তৃপক্ষের তোড়জোড় থেমে গেলে এ উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। পুরান ঢাকাজুড়ে আবাসিক ভবনে রয়ে গেছে কেমিক্যালের দোকান ও গোডাউন।
বনানীর এফআর টাওয়ার বিপর্যয়: ২৮ মার্চ আধুনিক ঢাকায় অন্যতম মর্মান্তিক এক দৃশ্য দেখেছেন দেশবাসী। বনানীর সুউচ্চ এফআর টাওয়ারে আগুনে মুহূর্তেই বিপর্যয় নেমে আসে। এদিন প্রাণ বাঁচানোর ভয়ে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যায় আটকেপড়াদের। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের সঙ্গে আগুন নেভাতে যোগ দেন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। উদ্ধারকাজে অংশ নেয় দু’টি হেলিকপ্টার। মর্মান্তিক এই ঘটনা মুহূর্তেই কেড়ে নেয় ২৫ তাজা প্রাণ।
এদিন আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের সময় ল্যাডারের সিঁড়িতে আটকে পা ভেঙে যায় দমকলকর্মী সোহেল রানার। এ সময় তিনি পেটেও গুরুতর আঘাত পান। এর পর সোহেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ৫ এপ্রিল তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। ৮ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ‘ফায়ার হিরো’ সোহেল।
কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় ঝরে ২২ প্রাণ: ১১ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জ উপজেলার চুনকুটিয়া এলাকায় অবস্থিত ‘প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’র কারখানায় প্রতিদিনের মতোই কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। বিকেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কারখানাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আগুন। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও ভয়াবহ দগ্ধ হন অন্তত ৩৪ শ্রমিক। কারখানায় অগ্নিগদ্ধ অবস্থায় একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে মারা যান ২২ শ্রমিক।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, এ ধরনের কারখানায় বেশ কয়েকটি দরজা থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’ দরজা থাকার কথা কিন্তু এ কারখানায় একটি মাত্র দরজা রয়েছে, যা দিয়ে ‘এন্ট্রি ও এক্সিট’ দুটোই হতো। কারখানার শ্রমিকদের জন্য কোনো দিক-নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড ছিল না। কর্তৃপক্ষের এ ধরনের গাফিলতির কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গাজীপুরের কারখানায় নিহত ১০: কেরানীগঞ্জে কারখানায় আগুনের ঘটনায় যখন মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তখনই ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুরে একটি ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন দমকলকর্মীরা। এরপর কারখানার ভেতর থেকে একে একে ১০ জনের মরদেহ বের করে আনা হয়। ফায়ার সার্ভিস জানায়, কারখানার দরজার কাছে আগুনের সূত্রপাত হলে শ্রমিকরা ভেতরে চলে যান। তবে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তারা ভেতরে আটকে পড়েন বলে তারা ধারণা করা হচ্ছে।
আগুনে পুড়েছে মার্কেট-শপিংমল: বহুবার আগুনে পুড়েছে, সমস্যা সমাধানে অনেকগুলো সুপারিশও দেওয়া হয়েছিল; এর পরেও বার বার আগুনে পুড়েছে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট। সর্বশেষ ৩০ মার্চ ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ডিএনসিসি কাঁচা মার্কেটের প্রায় পুরোটাই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিটের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দুই প্লাটুন সদস্যসহ বিমান এবং নৌবাহিনীর সদস্যদের সমন্বিত চেষ্টায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, মার্কেটে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পানির সংকট ছিল। ২০১৭ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর যে সুপারিশ করা হয়েছিল, তা মার্কেট কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে অনুসরণ করেনি।
২০ নভেম্বর টিকাটুলিতে রাজধানী সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও কাজ করছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলে পুড়ে যায় প্রায় ১৫টি দোকান।
ফায়ার সার্ভিসে তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডের মাসখানেক আগে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে রাজধানী মার্কেটে অগ্নি-নির্বাপণ মহড়ার কাজ হয়েছিল। সে সময় মার্কেটের বৈদ্যুতিক তারসহ আরও কিছু দুর্বলতা পাওয়া যায়। এসব ত্রুটি সারাতে মার্কেট কর্তৃপক্ষকে একমাস সময় দেওয়া হয়। মার্কেট কর্তৃপক্ষ দুই মাস সময় চেয়েছিল। এর আগেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
পুড়েছে বস্তি: ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুর চলন্তিকা মোড়ের পাশে ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত দেড়টার দিকে আগুন নেভানো সম্ভব হয়। এতে প্রায় পাঁচ-ছয়শ’ ঘর পুড়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিন হাজার পরিবার।
সর্বশেষ ২৬ ডিসেম্বর দিনগত রাতে মিরপুরের কালশীর বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে সর্বস্ব হারিয়েছেন প্রায় চারশতাধিক মানুষ।
বস্তিতে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, বস্তির প্রায় সবগুলো ঘরই থাকে কাঁচা এবং একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া। বস্তির প্রবেশপথ কম এবং খুবই সরু গলি। ফলে বস্তি পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছায় না।
এছাড়া, দেশে ছোট-বড় আরও অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯
পিএম/এফএম