ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি-২০১৯

বছরজুড়ে আলোচনায় নুসরাত হত্যাকাণ্ড

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯
বছরজুড়ে আলোচনায় নুসরাত হত্যাকাণ্ড

ফেনী: বিদায় নিচ্ছে আলোচিত ও সমালোচিত বছর ২০১৯। ঘটনাবহুল বছরটিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ড।

শুধু দেশে নয়- দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বেও আলোচিত ছিল এ ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডটি। মাদ্রাসার শিক্ষক-সহপাঠীদের যৌথ অপচেষ্টায় এমন হত্যাকাণ্ডে হতবাক করেছিল সারা বিশ্বের মানুষকে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ। ওইদিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। তারা সিরাজকে মুক্ত করতে রাস্তায় আন্দোলনও করে।

৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে জেলখানায় পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়।

ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা হয় নুসরাতের।

এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল আটজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয় ১০ এপ্রিল। সেদিন রাতেই মারা যায় নুসরাত। মৃত্যুর আগে ডাইং ডিক্লারেশন দিয়ে যায় সে- তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু ধরেই এগোতে থাকে মামলা। এক এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।

১১ এপ্রিল নুসরাতকে আনা হয় তার বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজার পর সমাহিত করা হয় কবরে। সেদিন নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে।

এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত পাঁচজনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে। নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। নুসরাতের থানায় হেনস্থা হওয়ার ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই এসআইকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

নুসরাত হত্যা মামলার আসামিরা।

১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্য দিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক গ্রহণ করা হয়। রায়ে ১৬ আসামির সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন বিচারক।

২৪ অক্টোবর বেলা সোয়া ১১টার দিকে ফেনী জজ কোর্টের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় ঘোষণা করেন। নারী ও শিশু নির্যাদন দমন আইনে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত।

বছরের শেষের দিকে রায়টিও সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তিতে নজির স্থাপন করে মামলাটি। এছাড়া দুই নারীসহ সব আসামির মৃত্যুদণ্ড ছিল আলোচনার বিষয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

সর্বশেষ অবস্থা:
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিচারিক আদালতের রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টে আসার দেড় মাসের মাথায় পেপারবুক ছাপার পর্যায়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) টাইপের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। পাঁচটি ভলিউমে এতে পৃষ্ঠা সংখ্যা চার হাজার ৪৯২। পেপারবুক প্রস্তুতের পর তা ছাপানোর জন্য ১৫ ডিসেম্বর সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেসে) পাঠানো হয়। ওই মামলায় গত ২৪ অক্টোবর রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। এর পাঁচদিনের মাথায় গত ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য নুসরাত হত্যা মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছায়, যা ১৪০/১৯ নম্বর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করতে পারেন। ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল, জেল আপিল ও আবেদন একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। তবে ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক প্রস্তুত করতে হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুসারে নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত আসামিরা সংশ্লিষ্ট শাখায় পৃথক ১৬টি জেল আপিল ও ১২টি আপিল করেছেন। তাদের মধ্যে সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি উম্মে সুলতানা, নুর উদ্দিন ও জাবেদ হোসেন রয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ৩০১৯ 
এসএইচডি/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।