ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি ২০২০

বছরজুড়ে পৃথিবীর ‘বিষফোঁড়া’ করোনা

ফারাহ্‌ মাহমুদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
বছরজুড়ে পৃথিবীর ‘বিষফোঁড়া’ করোনা প্রতীকী ছবি

ঢাকা: মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। বিশ্বজুড়ে যারা এ শহরটির নাম জানতেন না, এখন তারাও জানেন।

এ শহর থেকেই নতুন ধরনের এক ভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং মহামারি রূপ ধারণ করে। মহামারির বছর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেবে বিদায়ী ২০২০।

নতুন এক ধরনের করোনা ভাইরাস সব মহাদেশকে আক্রমণ করেছে, বাদ যায়নি এন্টার্কটিকাও। ভাইরাসটির অফিসিয়াল নাম দেওয়া হলো সার্স-কোভ-২ (Sars-Cov-2) এবং ভাইরাসে সংক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯ (Covid-19)।

ভাইরাসটি মানুষের শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত রোগীদের তীব্র জ্বর, শুকনো কাশি, মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষ্মণ দেখা যায়। তবে, কেউ কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। তারা ভাইরাসটি শরীরে বহন করে নিজের অজান্তে তা অন্য মানুষে ছড়িয়ে দেন

ইতোমধ্যে এ মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৮ কোটিরও বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর চেয়ে আরও বহু সংখ্যক মানুষে এতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃতের প্রকৃত সংখ্যাও এর চেয়ে বেশি, কেননা পরীক্ষার অভাবে অনেক রোগীকেই শনাক্ত করা যায়নি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র (৩ লাখ ৫০ হাজার), ব্রাজিল (১ লাখ ৯৩ হাজার), ভারত (১ লাখ ৪৮ হাজার), মেক্সিকো (১ লাখ ২৪ হাজার), ইতালি (৭৩ হাজার), যুক্তরাজ্য (৭২ হাজার), ফ্রান্স (৬৪ হাজার), রাশিয়া (৫৬ হাজার), ইরান (৫৫ হাজার), স্পেন (৫০ হাজার)।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ এবং প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ।

কোভিড-১৯ এ সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক মানুষেরা। অন্যদিকে, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরুষদের মৃত্যুহার নারীদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া, যারা ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অন্য রোগে ভুগছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। তবে, শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

কীভাবে ছড়ালো এ করোনা ভাইরাস?

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীন আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে উহানে এক ধরনের ‘ভাইরাল নিউমোনিয়া’ হচ্ছে। অজ্ঞাত কারণে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চীন কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে আরও তথ্য জানতে চান।

৪ জানুয়ারি এক টুইটে ডব্লিউএইচও জানায়, চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে নিউমোনিয়া আক্রান্তদের একটি ক্লাস্টার পাওয়া গেছে, এতে কারো মৃত্যু হয়নি এবং এর কারণ শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

৯ জানুয়ারি ডব্লিউএইচও জানায়, চীনা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে রোগটি নতুন করোনা ভাইরাসের কারণে হচ্ছে।

১১ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর দেয় চীন। ৩০ জানুয়ারি ডব্লিউএইচও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বিশ্বজুড়ে জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা দেয়।

২৩ জানুয়ারি মধ্যচীনের বৃহত্তম শহর উহানের গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গোটা শহর লকডাউন করে দেওয়া হয়। ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মানুষ লকডাউনের মতো ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করে ডব্লিউএইচও।

৩১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যে ২টি, রাশিয়ায়, ২টি, সুইডেনে একটি এবং কানাডায় চারটি কেইস শনাক্ত হয়। দেশগুলো চীন থেকে আসা মার্কিন নাগরিকদের ১৪ দিনের কোয়েন্টিন বাধ্যতামূলক করে। ভাইরাসটি সংক্রমণের ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে শরীরে এর লক্ষ্মণ প্রকাশ প্রায়, তাই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনের এ নিয়মটি এসেছে। সেসময় ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গোটা ইউরোপে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় সীমান্তও। ক্ষুদ্রতম এক ভাইরাসের আক্রমণে গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়।

২০১৯ সালের শেষদিকে উহানে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলো, চীনা গণমাধ্যম শহরবাসীকে শ্বাসতন্ত্রের ‘রহস্যজনক’ নতুন এক রোগের অস্তিত্বের কথা জানালো। উহান সামুদ্রিক ও বন্য প্রাণী কেনাবেচার বাজার হুয়ানান থেকে ভাইরাসটি ছড়ায় বলে জানায় চীন।

কিন্তু ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের পেছনে স্থানীয় ওই বাজারের ভূমিকা কী ছিলো এবং প্রথম কীভাবে ভাইরাসটি সেখানে এসেছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ডব্লিউএইচও ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে যে, ভাইরাসটি কীভাবে, কোত্থেকে এবং কখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, সে সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা গেছে। প্রাদুর্ভাবের ঠিক শুরুর অনেক তথ্যই হারিয়ে গেছে। যেমন হুয়ানানে কোন ধরনের এবং কতো সংখ্যক প্রাণী বিক্রি হতো এবং ওখানে কারা কাজ করতেন সে প্রশ্নের উত্তর জানা কঠিন হয়ে গেছে। ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীব সব পরিষ্কার করে বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সেখান থেকে কোনো তথ্য পাওয়ার আশা ক্ষীণ। ডব্লিউএইচও জানায়, বাজারটি ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল, নাকি মানুষে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার প্রভাবক— অথবা দু’ভাবেই কাজ করেছে কিনা, সেটি স্পষ্ট নয়।

তবে তথ্য-প্রমাণের অভাব ইচ্ছে করেই সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। জুলাই মাসে বিবিসিকে হংকংয়ের অনুজীববিজ্ঞানী ইউয়েন কোক ইয়ুং বলেন, জানুয়ারির মাঝামঝি সময় চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের সঙ্গে ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কিছুই নেই। ক্রাইম সিনের মতো পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে গোটা বাজার।

শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারির পেছনে ওই বাজারের ভূমিকা কী ছিলো তা স্পষ্ট না হলেও কোভিড-১৯ কবে প্রথম মানুষের মধ্যে ছড়ালো, সে প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, করোনা ভাইরাসটি গত বছরের নভেম্বর বা তারও আগে চীনে ছড়িয়েছে। তবে টের পাওয়া গেছে আরও পরে।

অন্যদিকে, ভাইরাসের সঙ্গে প্রোপাগান্ডাও কম ছড়ায়নি। ডব্লিউএইচও একাধিকবার সতর্ক করে জানিয়েছে, ভাইরাসের মহামারির সঙ্গে সঙ্গে ভুল তথ্যের মহামারিও মোকাবিলা করতে হবে।

গোটা বিশ্ব যখন স্তব্ধ, অচল এবং ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে, তখন কোভিড-১৯ রোগীদের সুস্থ করতে দিন-রাত পরিশ্রম করে গেছেন ডাক্তার, নার্সসহ জরুরি সেবার সঙ্গে জড়িত কর্মীরা। সংক্রমণ রোধের সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর মধ্যেই ভাইরাসটি বিবর্তনের মাধ্যমে আরও সংক্রামক ও নতুন রূপে বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে যায়।

ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স জানতে পারার পরই এর ভ্যাকসিন তৈরির কাজে নেমে পড়েন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ফাইজার এবং জার্মান বায়োটেকনোলজি কোম্পানি বায়োএনটেক যৌথভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করে, যা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মী এবং বয়স্করা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। এছাড়া, অক্সফোর্ডের একতি ভ্যাকসিনও অনুমোদন পেয়েছে। আরও অনুমোদন পেয়েছে চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন। বিশ্বের সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। পূর্বে যেকোনো ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রায় এক দশক সময় লাগলেও এ প্রথম মাত্র ছয়-সাত মাসেই ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন গবেষকরা। তবে, এ ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর, তা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মুক্ত বিশ্বে ফিরতে আগামী বছরের দিকে আশাবাদী চোখে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্ব।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।