ঢাকা: পতন প্রবণতা থেকে বেরিয়ে স্থিতিশীলতার পথে যাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রতি কার্যদিবসেই বাড়ছে মূল্য সূচক ও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ।
বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দূর হওয়ায় এমন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন স্থিতিশীল বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা হারানো পুঁজি পুরোপুরি ফিরে না পেলেও তাদের লোকসানের পরিমাণ অনেক কমে আসবে। তবে যারা কৌশলী তারা এ বাজার থেকেই মুনাফা করতে পারবেন। একইসঙ্গে তারা বিনিয়োগকারীদের সাবধানতার সঙ্গে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টানা তিন বছর ধরে পতনের বৃত্তে আটকে আছে শেয়ারবাজার। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শেয়ারবাজার। বিশেষ করে গত ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তা আরও গতিশীল হয়।
ক্রমাগত সূচকের উর্ধ্বমুখী প্রবণতায় গত ১৬ জানুয়ারি দীর্ঘদিন পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক (ডিএসইএক্স) স্পর্শ করে সাড়ে চার হাজার পয়েন্ট। যা টানা গত ৩৬ কার্যদিবস ধরে অব্যহত রয়েছে। অথচ গত ১৬ জানুয়ারির আগের ২৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ডিএসইএক্স সাড়ে চার হাজার পয়েন্টের ধারে কাছেও ছিল না।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধের স্থায়ী সমাধান না হলেও নির্বাচনের পর দেশে সহিংসতার পরিমাণ কমেছে। ফলে কিছুটা হলেও স্থিতিশীল হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল তা অনেকটা কেটে যাওয়ায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে উদ্যোগ নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে। এরই মধ্যে সরকার ব্যক্তিগত ও দলীয় বড় বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মন্দা বাজারে বিনিয়োগের তাগাদা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাজারের চিত্র দেখলে বোঝা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে এসেছেন। তাদের বিনিয়োগের কারণেই মূল্য সূচক ও লেনদেনে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া টানা ৩৬ কার্যদিবস ধরে মূল্য সূচক সাড়ে চার হাজার পয়েন্টের ওপরে থাকায় সহজেই অনুমান করা যায় ছোট বিনিয়োগকারীদেরও বাজারের ওপর আস্থা বেড়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, পতনের পর একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে এটাই নিয়ম। ১৯৯৬ সালের পতনের পর বাজার স্বাভাবিক হতে প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। ২০১০ সালের পতনের পর শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীল আচরণ তিন বছর পার করেছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন বাজার এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজার নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। সরকার এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে ভেতরে ভেতরে কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। বাজারে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় হয়েছেন। হয়তো সরকারের নির্দেশেই তারা সক্রিয় হয়েছেন।
বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে উল্লেখ করে বিএসইসি’র সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারবাজার একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ স্থান। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নির্ভর করে বাজার চিত্রের উপর। বাজারে যখন টানা সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধি পায় তখন আপনা আপনি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়ে যায়। সম্প্রতি বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে সহজেই অনুমান করা যায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।
ডিএসই’র সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে সরকার বেশ আন্তরিক। রাজনৈতিক অবস্থাও বেশ স্থিতিশীল হয়েছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে আসছেন। বেশ কিছু দিন ধরে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান বা পতনের ঘটনা ঘটছে না। ফলে বাজারে ছোট বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা বাড়ছে।
এদিকে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের মতে, বাজার বর্তমানে যে অবস্থায় বিরাজ করছে এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে বিনিয়োগ করা উচিত। তথ্য পর্যালোচনা না করে দুর্বল মৌল ভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লোকসানের পরিমাণ না কমে উল্টো বেড়ে যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাজার যে আচরণ কারছে তাতে বিনিয়োগকারীরা বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করলে লোকসান কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবেন। তবে ২০১০ সালের ধসে বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার একটি ঝুকিপূর্ণ বিনিয়োগের স্থান। কোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের আগে অবশ্যই কোম্পানির সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিতে হবে। পুঁজিবাজার ঝুকিপূর্ণ বাজার হলেও সচেতনতার সঙ্গে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীরা লাভের মুখ দেখবেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজারকে স্বাভাবিক করতে সম্প্রতি বিএসইসি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তা না হলে যেসব বিনিয়োগকারী না বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে।
স্কয়ার সিকিউরিটিজ হাউজের বিনিয়োগকারী আল আমিন বলেন, দুই মাসের মধ্যে মূল্য সূচক প্রায় ৬০০ পয়েন্ট বেড়েছে। গড় লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে বেশ ভালো। এ অবস্থা চলতে থাকলে আশা করি শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হবে।
আসিফ হাসান নামের অন্য এক বিনিয়োগকারী বলেন, ২০১০ সালে আমি প্রায় ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। এক পর্যায়ে আমার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ লাখ টাকা। এরপর ক্রমে শেয়ারের দাম কমে দুই লাখ টাকার নিচে চলে আসে। তবে কয়েক সপ্তাহে সূচকের উর্ধ্বমুখীর কারণে লোকসান কিছুটা কমে এসেছে। বাজার এমন আচরণ করলে আশা করছি লোকসান পুরোটা উঠে না আসলেও অনেকটা কমে আসবে।
বিনিয়োগকারী শরিফুল ইসলাম বলেন, লোকসান কিছুটা কমেছে। তবে বাজার যাতে নিয়মিত এমন আচরণ করে সেজন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২০৪ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৪