ঢাকা: কোনো অস্তিত্ব না থাকায় অবলুপ্ত হতে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটের আরও চার কোম্পানি। এরই মধ্যে কোম্পানিগুলোর একাধিক পরিচালক বিভিন্ন মাধ্যমে কোম্পানির অবলুপ্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন বলে এক সূত্রে জানা গেছে।
ওটিসি মার্কেটে যাওয়া কোম্পানি চারটি হলো- চিক টেক্সটাইল, রাসপিট ডাটা, রাসপিট ইনকরপোরেশন এবং সালেহ কার্পেট।
কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোম্পানি কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে কোম্পানি অস্বচ্ছল হয়ে পড়েছে এবং কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা যদি মনে করেন, এ ব্যবসা আর লাভজনক নয় শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে কোম্পানি অবলুপ্ত করা যেতে পারে। অর্থাৎ অবলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু করার আগে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হবে।
কোম্পানি আইন’১৯৯৪ এর ২৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, একটি কোম্পানি তিনভাবে অবলুপ্ত হতে পারে। যার মধ্যে প্রথমত, বাধ্যতামূলকভাবে আদালতের মাধ্যমে। যেখানে কোনো একজন বা একাধিক শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালক আদালতের কাছে কোম্পানির অবলুপ্তি প্রার্থনা করলে আদালত একজন লিকুইডেটর বা অবসায়ক নিয়োগ করবেন। তার কাছে শেয়ারহোল্ডাররা তাদের শেয়ারের প্রমাণাদি জমা দেবেন।
দ্বিতীয়ত, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে। যেখানে কোম্পানি লাভজনক না হলে বা ভবিষ্যতে আর লাভজনক হবে না এমন সম্ভাবনা থাকলে পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডাররা ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় কোম্পানির বিলুপ্তি ঘোষণা করবেন।
তৃতীয়ত, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আদালতের মাধ্যমে। অর্থাৎ কোম্পানির অবলুপ্তিতে পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডাররা যদি রাজি থাকেন তবে ঝামেলা এড়াতে আদালতে আবেদন জানালে আদালত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।
তবে এ চার কোম্পানির পরিচালকরা আদালতের মাধ্যমে কোম্পানির অবলুপ্তি চাচ্ছেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে বার্ষিক সাধারণ সভা না করা, লভ্যাংশ না দেওয়া এবং শেয়ার মূল্য অত্যধিক কমে যাওয়ায় বিশেষ সাধারণ সভার (ইজিএম) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অনুমতি নিতে গেলে পরিচালকরা তাদের রোষানলে পড়তে পারেন। ফলে ঘটতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এজন্য তারা আদালতের মাধ্যমে কিভাবে কাজটি সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, ডিএসইও এখন অস্তিত্ব বিলীন হওয়া কোম্পানিগুলোকে ওটিসি থেকে তালিকাচ্যূত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এমনকি কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী প্রক্রিয়া শুরু করলে ডিএসই’র পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ডিএসই’র এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানির অবলুপ্তি কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যেহেতু কোম্পানিগুলো মূল মার্কেটে ফিরে আসতে পারেনি এবং বর্তমানে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই তাই এগুলোর এখন অবলুপ্ত হওয়া প্রয়োজন। যদি কোম্পানিগুলো এ ধরনের উদ্যোগ নেয় তবে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ওটিসি মার্কেটের প্রায় ৬ হাজার বিনিয়োগকারীর হাতে কাগুজে শেয়ার রয়েছে। অস্তিত্বহীন এসব কোম্পানির ব্যবসাও বন্ধ থাকায় বিনিয়োগকারীরা কোনো লভ্যাংশ পান না। আবার শেয়ার বিক্রিও করতে পারছেন না অনেক বিনিয়োগকারী। ফলে আটকে আছে তাদের বিনিয়োগ।
আবার এসব কোম্পানির শেয়ারে আটকে আছে বিনিয়োগকারীদের টাকা। ফলে ক্রেতার অভাবে তারা তাদের ওই শেয়ার বিক্রিও করতে পারছেন না।
কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ থাকলে, অব্যাহতভাবে লোকসান করলে, বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ না দিলে, নিয়মিত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) না করলে বিএসইসি ওইসব কোম্পানিকে ওটিসি মার্কেটে পাঠায়।
জানা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসইতে) বর্তমানে ওটিসি বাজারভূক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৬৮টি এবং সিএসইতে ৫৪টি। বছরের পর বছর যেসব কোম্পানি এজিএম করছে না এমন কোম্পানিকে মূল বাজার থেকে তালিকাচ্যূত করে ওটিসি বাজারে স্থানান্তর করা হয়। পরে এসইসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী কাগুজে শেয়ার থেকে ডি-মেডেট শেয়ারে রূপান্তর না করতে পারায় ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কোম্পানিকে এ বাজারে স্থানান্তর করা হয়।
অবশ্য ওটিসি মার্কেটের উন্নয়নে এসইসি’র কাছে এরই মধ্যে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাজারে বিদ্যমান ‘এ’, ‘বি’, ‘এন’ এবং ‘জেড’ ক্যাটাগরির মতো ‘ডি’ নামে নতুন ক্যাটাগরির অধীনে ওটিসি বাজারভূক্ত অস্তিত্বসম্পন্ন এবং স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন কোম্পানিকে মূল বাজারে ফিরিয়ে আনা হোক।
কোম্পানি অবলুপ্তির বিষয়ে সিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ সাজিদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কোনো কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতেই পারে। তবে কোম্পানি পরিচালকরা যদি কোম্পানির অবলুপ্তি করতে চান, তবে কোম্পানি আইন মেনে করতে হবে। আর অবলুপ্তি প্রক্রিয়ায় কোম্পানির সকল সম্পদ বিক্রি করে আগে ব্যাংক, বিমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
যদি কোম্পানির পরিচালকরা কোম্পানির অবলুপ্তি করেন তবে তা ভালো উদ্যোগ। কারণ, অনেকদিন ধরে বিনিয়োগকারীদেরও বিনিয়োগ আটকে আছে।
ওটিসি মার্কেটে নেওয়ার সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওটিসি মার্কেটে নেওয়া হলেও এসব কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে থাকবে। ক্রমান্বয়ে কোম্পানিগুলোর অবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। নজরদারির ফলে একটি পর্যায়ে কোম্পানিগুলো ভালো অবস্থায় ফিরলে আবার মূল বাজারে এদের স্থানান্তরিত করা হবে।
কিন্তু ২০০৯ সালের শেষ দিকে ওটিসি মার্কেট চালুর পর চার বছর অতিক্রান্ত হলেও কোনো কোম্পানি ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে ফিরতে পারেনি। অথচ ওটিসি মার্কেটের প্রায় ছয় হাজার বিনিয়োগকারীর হাতে কাগুজে শেয়ার রয়েছে। এমনকি সম্প্রতি ওয়াটা ক্যামিকেল কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আবার থমকে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও কমিশন মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, কোম্পানি অবলুপ্তির দায়িত্ব আমাদের নয়। বিনিয়োগকারীদের দেখে-শুনে, বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। যদি কোম্পানি মুনাফা না করতে পারে তবে কোম্পানি আইন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডাররাই কোম্পানি অবলুপ্ত করবেন। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।
এদিকে, ডিএসই’র কাছে কোম্পানিগুলোর যেসব ঠিকানা দেওয়া আছে সেখানে তাদের কোনো অফিস নেই। এমনকি টেলিফোন নম্বরগুলোও বন্ধ। যার মধ্যে চিক টেক্সটাইলের ঠিকানা দেওয়া আছে- Addakha Ershadullah Sarak (Banashpati), South Sheikhdi, Road # 4, House # 12, Jatrabari, Dhaka-1000.
রাসপিট ডাটা ও রাসপিট ইনকরপোরেশনের ঠিকানা A.K Complex (4th Floor) 19, Green Road, Dhaka- 1205.
সালেহ কার্পেটের ঠিকানা Kadam Rasul, Bhatiari, Chittagong.
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৪