ঢাকা: লোকসানি ও বিতর্কিত মাইডাস ফিন্যান্স কোম্পানিকে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোনো লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও বিতর্কিত এ কোম্পানিকে সেই সুযোগ দিল বিএসইসি।
তবে বিএসইসি ও কোম্পানির দাবি আইন মেনেই এই রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে মাইডাস ফিন্যান্স কোম্পানির গত নয় মাস (জুলাই-২০১৩ থেকে মার্চ-২০১৪) পর্যন্ত পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৪১ কোটি ৮০ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও কমিশনের মুখপাত্র সাইফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আইন মেনেই মাইডাস ফিন্যান্সকে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ’
লোকসানি কোম্পানিকে আইনের কোন ধারা বলে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় রাইট ইস্যু আইনের এমন কোনো ধারা আছে যার বলে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে সঠিক কোন ধারা বলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তা বলা সম্ভব না, আর এটা আমারও জানা নেই। কমিশন নিশ্চয়ই আইনের বাইরে গিয়ে এ কোম্পানিকে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেয়নি। ’
মাইডাস ফিন্যান্সের কোম্পানি সচিব আসলাম আহমেদ খান বলেন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (রাইট ইস্যু) রুলস ২০০৬-এর ১০ (এইচ) ধারায় বলা আছে, মুনাফায় থাকাকালীন কোনো কোম্পানি রাইট আবেদন করলে তা অনুমোদন যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সে হিসেবে আমাদের কোম্পানি বর্তমানে লোকসানি হলেও যখন রাইট শেয়ারের জন্য আবেদন করা হয় তখন লাভজনক ছিল। তাই আমাদের কোম্পানির রাইট শেয়ার অনুমোদন আইন অনুযায়ীই হয়েছে।
এছাড়া কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধ্যবাধকতা থাকায় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ রাইট শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
দ্বিতীয়বার রাইট আবেদনের আগের তিন প্রান্তিক এবং পরবর্তী তিন প্রান্তিকে লোকসান হলেও মাঝে এক প্রান্তিকে কীভাবে মুনাফা করা হলো-এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিও আমাদের একই প্রশ্ন করেছিল। এর জবাব আমরা আর্থিক প্রতিবেদনের ৮৭ পৃষ্ঠার ১৯ (১) ধারায় উল্লেখ করেছি।
অন্যদিকে বিএসইসির এমন বিতর্তিত সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধীতা করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি বিএসইসি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফটকা কোম্পানিকে আইনের তোয়াক্তা না করেই বাজার থেকে পুঁজি উত্তোলনের সুযোগ করে দিচ্ছেন। ফলে বিনিয়োগকারীদের কষ্টের পুঁজি হারাতে হচ্ছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে এমন সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে বিএসইসির কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে আছে কি-না তা খতিয়ে দেখার দাবিও করেছেন এসব বিনিয়োগকারী।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ বলেন, কোম্পানিটির বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট বুঝা যায় তারা রাইট শেয়ার ছাড়তে কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে। এ কোম্পানিকে রাইট শেয়ারের অনুমোদন দেওয়ায় বিএসইসি ভূমিকাও আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। এ ধরনের কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত, তাতের শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
সম্প্রতি বিএসইসির কমিশন সভায় এ লোকসানি কোম্পানিকে ১আর : ১ হারে রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দিয়েছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মোট ৬০ কোটি ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৮০ টাকা উত্তোলন করবে।
অথচ বিএসইসি নিজেই গত বছরের ৭ মে লোকসানি কোম্পানি হয়েও রাইট শেয়ার ঘোষণা দিয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করায় মাইডাস ফাইন্যান্সকে ২ লাখ এবং ইস্যু ম্যানেজার লংকা-বাংলা ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডকে আরও ২ লাখ টাকা জরিমানা করে। কোম্পানির এ ধরনের তথ্য প্রকাশকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (রাইট ইস্যু) রুলস ২০০৬-এর ৩ (এইচ) ধারা লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছিল বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো রহস্যজনক কারণ রয়েছে বলেও মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কোনো লোকসানি কোম্পানির রাইট শেয়ার অনুমোদন দেওয়া কোনোভাবেই বিএসইসির উচিত নয়। কারণ তাতে চূড়ান্তভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এছাড়া কোনো লোকসানি কোম্পানির বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের রাইট শেয়ার কেনার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
গত কয়েক বছর ধরে লোকসানে রয়েছে মাইডাস ফিন্যান্স। ২০১১-১২ সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসানের পরিমান ছিল প্রায় ১২ কোটি টাকা। তারপরও ওই বছরেই তিনটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে দুটি রাইট শেয়ার দেওয়ার জন্য বিএসইসিতে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে লোকসানে থেকেও রাইট শেয়ারের ঘোষণা দেওয়ায় মাইডাস ফিন্যান্স এবং ইস্যু ম্যানেজার লংকা-বাংলা ইনভেস্টমেন্টকে ২ লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
জরিমানা করা হলেও বিএসইসির অনুমোদন পাওয়ার জন্য আরও তৎপর হয়ে ওঠে কোম্পানির পরিচালকরা। এজন্য তারা বিভিন্ন কারসাজির আশ্রয়ও নেয়।
তথ্য পর্যালোচায় দেখা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই-২০১২ থেকে মার্চ ২০১৩) অনীরিক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ২০১২-১৩ সমাপ্ত অর্থবছরের চতুর্থ প্রন্তিকে (জুলাই-২০১২ থেকে জুন-২০১৩) কোম্পানিটির পূর্বের সব লোকসান কাটিয়ে ৯৪ লাখ টাকা মুনাফা দেখায়।
বিএসইসির কিছু অসাধু কর্মকর্তা, নীরিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানির যোগসাজশে কৃত্রিমভাবে আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা দেখিয়ে ২০১৩ সালের ১৯ আগস্ট আবারও রাইট শেয়ার ছাড়ার জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, বিএসইসিতে দ্বিতীয় দফায় রাইট অনুমোদনের আবেদন করেই আবারও লোকসান দেখাতে শুরু করে কোম্পানিটি। গত তিনটি প্রান্তিকের প্রতিটিতেই লোকসান দেখিয়েছে এ কোম্পানি। যার মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-২০১৩ থেকে ডিসেম্বর-২০১৩) কোম্পানিটির লোকসান হয় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৮০ হাজার, অর্ধবর্ষিকীতে (জুলাই-২০১৩ থেকে ডিসেম্বর-২০১৪) লোকসান হয় ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-২০১৪ থেকে মার্চ-২০১৪) লোকসান হয়েছে ১৩ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৪