ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শেয়ারবাজার

প্রতারক ওবায়দুল! ওরিয়নের শেয়ারে নিঃস্ব লাখো বিনিয়োগকারী

শেখ নাসির হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৪
প্রতারক ওবায়দুল! ওরিয়নের শেয়ারে নিঃস্ব লাখো বিনিয়োগকারী

ঢাকা: ওরিয়ন ফার্মার শেয়ার কিনে নিঃস্ব হয়েছেন কয়েক লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী। শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের কাছে এই কোম্পানির সিইও ওবায়দুল করিম প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।

কোম্পানির ইপিএস কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাজার থেকে টাকা তুলে সঠিক বিনিয়োগ না করে তা গায়েব করেছেন ওরিয়নের ওবায়দুল। প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টস সিস্টেমেও ধরা পড়েছে বড় ধরনের ঘাপলা ও ধাপ্পাবাজি।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূলত আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি করে আয় বেশি দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলোভন দেখায় পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ওবায়দুল করিমের ওরিয়ন ফার্মা। প্রতিটি শেয়ারের পেছনে ৬০ টাকা বিনিয়োগ করে তার ১৮ টাকাই লোকসানে চলে গেছে। বর্তমানে এর শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৪২ টাকায়।

সূত্র বলছে, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি আর ভালো চলেনি। কোম্পানির আয় ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে ওরিয়ন ফার্মারি কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী।
 
এ কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা প্রিমিয়ামসহ মোট ৬০ টাকা করে নিয়েছেন ওবায়দুল করিম। আইপিও’র আগে নিজের প্রতিষ্ঠানকে ভাল কোম্পানি বলে অভিহিত করে এ অতিরিক্ত টাকা নেন তিনি। কিন্তু এক বছর না যেতেই এ কোম্পানির শেয়ার মূল্য কমে ৪২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। তাই মুনাফা তো দূরের কথা শেয়ার প্রতি লোকসান আছে ১৮ টাকা।

ফলে নিঃস্ব হয়েছেন মার্জিন ঋণ নিয়ে এ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী।   তাদের পোর্টফোলিওতে ইক্যুইটি ঋণাত্বক হয়ে আছে।
 
সূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি করে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর তা বিচার বিবেচনা না করেই এ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তৎকালীন সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকেও এ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তা আমলে নেয়নি বিএসইসি।
 
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজার থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানি যথাযথভাবে বিনিয়োগ করেনি। ফলে আশংকাজনকভাবে এ কোম্পানির মুনাফা কমছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। এমনকি এ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ায় বিএসইসি’র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
 
অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরেও এ কোম্পানির ইপিএস কমার আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে আরও লোকসানের মুখে পড়তে পারেন এ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি মূলত অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিতেই কোম্পানির কর্তৃপক্ষ আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি দেখায়। আর তা সত্বেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্য’র সাধারণ সম্পাদক আ ন ম আতাউল্লাহ নাইম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোম্পানিটি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করেছে। ’

তিনি বলেন, টাকা নেওয়ার আগে তারা দাবি করেছিল ভাল কোম্পানির জন্য ভাল প্রিমিয়াম দিতে হবে। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরই কোম্পানির মুনাফা এবং ইপিএস আশংকাজনক হারে কমতে থাকে। তাই এ কোম্পানির ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।  

বিএসইসি’র উচিত কোম্পানিটি আইপিও’র টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করেছে কি-না তা খতিয়ে দেখা, বলেন আতাউল্লাহ নাইম।  
 
কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ অর্থবছরে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ২০ শতাংশ শেয়ার ও ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এ সময়ে শেয়ার প্রতি আয় দেখানো হয় ৬.০২ টাকা।
 
কিন্তু উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শুরু হওয়ার পর গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয় মাত্র ১৫ শতাংশ নগদ। এ সময়ে ইপিএস দেখানো হয়েছে মাত্র ৪.০৬ টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রয়ে দুই টাকা কম।
 
ওরিয়ন ফার্মার আইপিও অনুমোদনের আগে ডিএসই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কোম্পানির চলতি সম্পদের চেয়ে চলতি দায় ৫৩ কোটি টাকা বেশি। তিন বছরে কোম্পানিটি দুই বার সম্পদ মূল্যায়ন করেছে। এ সময়ে সম্পদ মূল্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১৭ গুণেরও বেশি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
 
এছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে এক বছরে কোম্পানির আয় ৫০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
 
ডিএসই জানিয়েছিল, বেশি প্রিমিয়ামের জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে তারা এ কাজ করেছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম একই সঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এগুলো হল - ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন ইনফিউশন এবং বেলাহাসা একম জিবি। যা স্পষ্টতই কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।
 
অ্যাকাউন্টস পরিচালনার ক্ষেত্রেও ধরা পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির বড় ধরনের ধাপ্পাবাজি ও ঘাপলা। ডিএসই জানায়, আর্থিক রিপোর্টিয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক একাউন্টস স্ট্যান্ডার্ড মানেনি ওরিয়ন। ফলে এই কোম্পানির আইপিও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যান্ত ঝুঁকিপুর্ণ। অন্যদিকে এই গ্রুপের তালিকাভুক্ত আরও দুটি কোম্পানি কহিনুর কেমিক্যাল এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের পারফরমেন্স অত্যন্ত দুর্বল।
 
কোম্পানির মুনাফা কমার কারণ জানতে গত তিনদিন যাবত কোম্পানির একাধিক অফিসিয়াল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি কোম্পানি সচিব ফেরদৌস জামানের মোবাইলে একাধিকবার এসএমএস ও যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।