ঢাকা: এক দিনের দরপতনে কেঁপে উঠেছে বিশ্ব শেয়ারবাজার। চীনের সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স থেকে ভারতে সেনসেক্স সূচক, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর ইনডেক্সসহ বিশ্বের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিশ্ব শেয়ারবাজারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। উল্টো ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ পতনের কবলে পড়া বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেবে একদল বিনিয়োগকারী। তারা তাদের অর্থ বিনিয়োগের জন্য নতুন বাজার খুঁজবে।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চলে আসতে পারে পছন্দের তালিকায়। ফলে বিশ্ব শেয়ারবাজারের পতন আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিতে পারে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের জন্য। বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ খুব একটা বেশি না। মোট লেনদেনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অবদান ৫ শতাংশেরও নিচে (৪.৯২ শতাংশ)।
তাদের মতে, বিনিয়োগকারীরা অর্থ তুলে নেওয়ার পর তা অলস ফেলে রাখবে না। অন্য কোনো বাজারে তারা নিশ্চয় বিনিয়োগ করবে। আর বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য খুবই ভালো অবস্থায় আছে। ফলে নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বাংলাদেশে আসতে পারে।
তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বিদেশি বড় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার কতোটা সমর্থ রয়েছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি মনে করেন বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগ করলে তাদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের(ডিএসই) সাবেক সভাপতি ও নতুন আত্মপ্রকাশ করা ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আহসানুল ইসলাম টিটু বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ব শেয়ারবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অর্থনৈতিকভাবে তেমন সম্পর্ক নেই। তবে মনোতান্ত্রিক একটি প্রভাব আছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব শেয়ারবাজারের পতন বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণে যেসব বাজারে পতন দেখা দিয়েছে, ওই বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা অর্থ তুলে নিয়ে নিশ্চয় বসে রাখবে না। তারা বিনিয়োগের জন্য অন্য বাজার খুঁজবে।
সেক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগটা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আসতে পারে। তাছাড়া তেলের দাম কমাটাও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। বাংলাদেশের তেল কোম্পানি নেই, সুতরাং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের লোকসান করার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক রিসার্চ কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হাসান বাংলানিউজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গুজবে বিনিয়োগ করেন না। তারা সার্বিক তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করে।
তার মতে, গত কয়েক বছরের বাজার চিত্র দেখলে দেখা যাবে, বাজার এক মাস ভালো থাকে, তো পরের মাসেই খারাপ হয়। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কি না এটি একটি বড় বিষয়। তাছাড়া তাদের বিনিয়োগ এক দুই টাকা না। তারা মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন। সেক্ষেত্রে এতো ছোট বাজারে তারা তাদের টাকা এনে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে কি না সেটি ভাবার বিষয়।
তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের বাজার ভালো অবস্থানে আছে। এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। তবে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির দাম না বেড়ে দুর্বল কোম্পানির দাম বাড়ছে। এটি বাজারের জন্য খুব ভালো সংবাদ না।
তাছাড়া ২০০৮ সালেও বিশ্ব শেয়ারবাজারে পতন দেখা দিয়েছিলো। সে সময় খুব একটা বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসেনি। তারপরও বিশ্ব শেয়ারবাজারের পতন দীর্ঘ হলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের একটি অংশ আসতেও পারে, বলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
এদিকে গত সোমবার কালো দিবস হিসেবে দেখা দেয় বিশ্ব শেয়ারবাজারে। বড় ধরনের পতন ঘটে গুরুত্বপূর্ণ শেয়ারবাজারগুলোতে। একদিনেই চীনের সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স পড়ে যায় সাড়ে ৮ শতাংশ। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ৭ লাখ কোটি রুপি গায়েব হয়ে যায়। সেনসেক্স সূচকের পতন ঘটে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
পতনের এ ধাক্কা থেকে বাঁচতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারও। ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’ ইনডেক্স নেমে যায় আড়াই শতাংশ। এছাড়া জাপান, তাইওয়ানসহ বিশ্বের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শেয়ারবাজারে সূচকের পতন ঘটে বিপুল হারে। সূচকের লাগামহীন পতনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টালমাটাল হয়ে পড়ে সারা বিশ্বের শেয়ারবাজার।
বিশ্ব শেয়ারবাজারের পতনের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব শেয়ারবাজারের পতনে চীনের অর্থনীতি একটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে। সেই সঙ্গে স্বর্ণের ও তেলের দাম কমেছে। এর অর্থ হলো কমোডেটি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি কারেন্সি অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে কারেন্সি ও কমোডেটির প্রভাব বিশ্ব শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের(বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের যে দাম তা বিনিয়োগের জন্য উপযোগী।
তিনি বলেন, বিশ্ব শেয়ারবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে দেশের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ তুলে নিলেও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বপন কুমার বালা বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন মোট লেনদেনের ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করে।
তাছাড়া বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যেসব কোম্পানি তালিকাভূক্ত তার মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানি বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত। বাকি কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটিও অন্য কোন শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত না। সুতরাং বিশ্ব শেয়ারবাজারের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, স্বর্ণের ও তেলের দাম কমায় কমোডেটি তলানিতে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কারেন্সি অবমূল্যায়ণ হয়েছে। ফলে কমোডেটি ও কারেন্সি বিশ্ব শেয়ারবাজারে পতনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আর এ
পতনে চীনের অর্থনীতি ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে।
টিটু বলেন, চীনের শেয়ারবাজার গত ৬ বছর ধরেই অতিমূল্যায়িত ছিলো। আর বড় বড় তেল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তালিকাভূক্ত। ফলে তেলের দাম কমার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ফল করেছে।
ডিএসইর সাবেক জৈষ্ঠ সহ-সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ব শেয়ারবাজারের কোন প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ার কথা না। কারণ ওইসব বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারের কোন যোগসূত্র নেই। সুতরাং বাংলাদেশে
বিশ্ব শেয়ারবাজারের নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়ার সুযোগ নাই।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৫
এএসএস/এনএস