ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শেয়ারবাজার

বুক বিল্ডিংয়ের ফাঁদ

কারসাজিতে ৪শ’ কোটি টাকা তুলছে একমি

মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
কারসাজিতে ৪শ’ কোটি টাকা তুলছে একমি

ঢাকা: বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে ৪২৬ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে ওষুধ খাতের কোম্পানি একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড।

শেয়ার প্রতি ৮৫ দশমকি ২০ টাকা দামে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩১ হাজার ১০০টি শেয়ারের বিনিময়ে ১১ এপ্রিল থেকে টাকা তোলা শুরু হয়েছে।

আসছে ২১ এপ্রিলের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এ টাকা তুলে নিচ্ছে কোম্পানিটি।

প্লেসমেন্টধারী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কারসাজি এবং নিজেদের মনগড়া ও বানানো আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই টাকা তুলে নিচ্ছে বলে কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মিজান উর রশিদ চৌধুরী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন। অভিযোগে বিএসইসি অনুমোদিত আর্থিক প্রতিবেদনটির ১০টি অসঙ্গতি তুলে ধরে একমির আইপিও অনুমোদন স্থগিত করতে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খায়রুল হোসেনের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থমন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থা বরাবর পাঠান তিনি। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, বিডিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানির সম্পদের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনন্ত ৩৫ টাকা বেশি দাম বাজার থেকে তুলে নেওয়ায় ক্ষুব্ধ কমিশনও। সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রধান কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী সিলেটে ডিএসইর এক অনুষ্ঠানে বলেন, এতোদিন বিনিয়োগকারী ও সরকারের ওপর মহলসহ সবাই প্রিমিয়ামের মাধ্যমে আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হলেই কমিশনকে প্রশ্ন করতেন। কোম্পানি ৫০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসতে চেয়েছিল। এই টাকা প্রিমিয়াম পাওয়ার দাবি রাখে না বলে তাদের প্রিমিয়ামসহ আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বুক বিল্ডিংয়ে টাকা সংগ্রহের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এ পদ্ধতিতে অতি মূল্যায়িতভাবে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। তিনি উপস্থিত সবার কাছে প্রশ্ন রাখেন, এবার দোষটা কার?

এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুঁজিবাজার। এতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা, মন্তব্য হেলাল উদ্দিন নিজামীর।

মিজান উর রশিদের অভিযোগে বলা হয়, আইপিওর চলমান পদ্ধতি অনুযায়ী ৫ বছরের ওয়েটেড ইপিএসের সঙ্গে ১০ গুণ করে সর্বশেষ সময়ের শেয়ারপ্রতি সম্পদ যোগ করতে হয়। এরপর ২ দিয়ে ভাগ করতে হয়। এ হিসেবে একমির দাম হয় ৫০ দশমিক ৮১ টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিএসইসির বেধে দেওয়া ৫৬ দশমিক ৮০ টাকা থেকে ৮৫ দশমিক ২০ টাকায় কোম্পানিটির শেয়ার নিলাম হওয়ার কথা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কারসাজিতে একমি ল্যাবরেটরিজের কাট অব প্রাইস ৮৫ দশমিক ২০ টাকা নির্ধারিত হয়। যা বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা চলমান মন্দা বাজারে এতো বেশি দামে একমির শেয়ার কিনে নানা সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

অভিযোগে আরো বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একমির শেয়ারের যারা বিডিংয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই একমির প্লেসমেন্ট শেয়ারের সঙ্গে জড়িত। বাজারে আসার পর যাতে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন, তাই তারা বেশি দামে বিডিং তথা ‘কাট অব প্রাইসে’ ৮৬ টাকা নিধারণ করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আলফা ক্যাপিটাল। প্রতিষ্ঠানটি একমির ৫ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছে। এছাড়াও পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১০ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ৫ লাখ, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ৫ লাখ, সাউথইস্ট ব্যাংক ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০০টি, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স ১০ লাখ, ইউসিবিএল ৭৬ লাখ ৯২ হাজার ৩০০টি ও ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স ৫ লাখ শেয়ার কিনেছে। অথচ এই কোম্পানিগুলো একমির ইন্ডিকেটিভি দাম নির্ধারণে ৮০ টাকা বলেছে।

এছাড়াও একমির ইস্যু ম্যানেজার ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে একমির প্রায় ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে আইসিবির হাতে রয়েছে ৫৮ লাখ শেয়ার। যা শতাংশের হিসেবে ৩ দশমকি ৫৯ । আইসিবি ইউনিট ফান্ডের হাতে ৫৮ লাখ, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের হাতে ১৯ লাখ, আইসিবি সিকিউরিটিসজের কাছে ১৯ দশমকি ৫০ লাখ এবং বাংলাদেশ ফান্ডের নামে ৪৮ লাভ শেয়ার রয়েছে। সব মিলে একমির প্রায় ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে আইসিবির হাতে। ফলে সেকেন্ডারি বাজারে একমির শেয়ার দামকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ২০১৩ সালে একমির করভুক্ত টার্নওভার ছিল ৯৫৩ কোটি টাকা। যা ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। সে বছর এই টার্নওভার ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়লেও একই বছর মুনাফা বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ৫০ কোটি টাকা। যা পরের বছর ২০১৪ সালে ৮৯ কোটি টাকা ছাড়ায়। পুঁজিবাজারের তালিকাভূক্ত হতে কোম্পানিটি পরিকল্পিতভাবে এক বছরে মুনাফা দ্বিগুণ করার অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল।

বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্টান্ডার্ড (বিএএস)-১৬ অনুযায়ী, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অবচয়যোগ্য সম্পদ। কিন্তু একমি ল্যাবরেটরিজের এই সম্পদ থাকলেও অবচয় চার্জ করা হয় না। এতে কোম্পানিটি নিয়মিতভাবে সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখিয়ে আসছে। এর পরবর্তী অভিযোগে বলা হয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কোম্পানিটি পরিকল্পিতভাবে সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছে যা বিনিয়োগকারীদের কাছে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

দুই বছর আগে ২০১২ সালে কোম্পানির মালিকানাধীন জমির আর্থিক মূল্য ছিল ১২ কোটি টাকা। যা ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৪০২ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে কোম্পানির ভবন ও মেশিনারিজের আর্থিক মূল্য ছিল ১০৫ কোটি টাকা। যা ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৫৮৯ কোটি টাকায়। এই বিনিয়োগ শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। কোম্পানির টার্নওভার ও মুনাফা দেখলে এটাই পরিলক্ষিত হয়।

এর পরের অভিযোগে বলা হয়, কোম্পানি শেয়ারহোল্ডাদের জন্য ২০১৪ সালে নগদ মুনাফা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় কোম্পানির হাতে কোনো সঞ্চিতি বা রিজার্ভ নেই। ২০১৪ সালে এই নগদ মুনাফা প্রদান করলে কোম্পানির মোট মুনাফা অনেক কমে আসবে। একমি একটি বড় কোম্পানি হওয়ার পরেও কোনো ধরনের সিএসআর কার্যক্রমে অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। ২০১৪ সালে কোম্পানি সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি টাকাও খরচ করেনি। কোম্পানিটি অন্যদিকে আগের বছর ২০১৩ সালে এই খাতে মাত্র ৪৬ লাখ টাকা খরচ করে।

সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, পুঁজিবাজারে কোম্পানির মৌলভিত্তিক বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর্নিং পার শেয়ার বা ইপিএস। এই ইপিএস গণনায় কৌশল অবলম্বন করেছে কোম্পানিটি। বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্টান্ডার্ড (বিএএস)-৩৩ অনুযায়ী, কোনো বছরের শেষে যে পরিমাণ শেয়ার থাকবে তার ওয়েটেড দিয়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) গণনা করতে হয়। এ হিসাবে ২০০৯-১০ অর্থবছরে একমির ইপিএস হয় ২২ দশমিক ৭৮ টাকা।

কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী বছরগুলোর সঙ্গে ইপিএসে ধারাবাহিকতা দেখাতে ১ দশমকি ৯৬ টাকা ইপিএস দেখিয়েছেন। কারণ ২০১০-১১ অর্থবছরে ২ দশমকি ৯৭ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪ দশমকি ১০ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪ দশমকি ১৯ টাকা ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমকি ৬৫ টাকা ইপিএস হয়েছে।

এছাড়াও আইপিওর মাধ্যমে নেওয়া টাকা খরচে কোম্পানি চতুরতার  সুযোগ নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় অবেদনপত্রে। এতে বলা হয়, অনুমোদন পাওয়া প্রসপেক্টাসে মোট ১৮৯ কোটি টাকার বেশি মেশিন ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করার কথা উল্লেখ করেছে কোম্পানিটি। পাশাপাশি এসব মেশিন ও যন্ত্রপাতির মূল্য তালিকা আকারে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন দেশ থেকে এসব মেশিন কেনা হবে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। অথচ এসব মেশিনের দাম চীন, জাপানের মতো দেশ ভেদে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে।

অপরদিকে, আইপিওর মাধ্যমে নেওয়ার অর্থ দিয়ে তিনটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে কোম্পানির হিসাবে আইপিওর মাধ্যমে ৪০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন, কোম্পানির যেহেতু কোনো রিজার্ভ মানি নেই তাহলে আইপিও প্রকল্পের বাকি ৩০ কোটি টাকা যোগান আসবে কোথা থেকে।

সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়, শ্রম আইনানুযায়ী, ২০০৬ সাল থেকে একটি কোম্পানির নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক ফান্ড হিসাবে জমা করতে হয়। এবং সেখান থেকে দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিবছর শ্রমিকদের মধ্যে সমানহারে বিতরণ করার বিধান রাখা হয়েছে। এমতাবস্থায় আইনটি একমির জন্য ২০০৬ সাল থেকে কার্যকর হলেও ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত তা করা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, একমি ল্যাবরেটরিজ বেশি দামে টাকা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। কোম্পানিটি এতো দাম পাওয়ার যোগ্য না। এছাড়া একমির সম্পদ পূর্ণমূল্যায়ন ঠিক হয়নি।

২৮ ফেব্রুয়ারি বিআইপিডির প্রশিক্ষণে তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাবির আরেক অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই দাম নির্ধারণ করেছেন। তবে এই প্রতিযোগিতা যে কতোটুকু প্রতিযোগিতা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
এমআই/আইএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।