৪১নং হাইওয়ে থেকে: সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। সমুদ্রপথে এসে জঙ্গল পেরিয়ে অপরিচিত হাইওয়ে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে মানবপাচারকারীদের।
এক্ষেত্রে ৪নং হাইওয়ের পাশ ঘেরা সমুদ্র তীর দিয়ে প্রবেশ করলেও পাচারকারীরা জঙ্গল পেরিয়ে ৪১নং হাইওয়ে ব্যবহার করতে পারে বলে ধারণা থাই নিরাপত্তা বাহিনীর। ফলে ৪১নং হাইওয়েতেও চলছে কড়া তল্লাশি।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) থাইল্যান্ড সময় রাত ১১টায় সুরাতহানি চেকপোস্টে পুলিশি তল্লাশি চলতে দেখা যায়। নির্দিষ্ট দূরত্বের বাসগুলো ছেড়ে দিলেও প্রতিটি কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, লরিকে তল্লাশি করা হচ্ছে কঠোরভাবে।
সাধারণত এসব যানবাহনে করেই অভিবাসী প্রত্যাশীদের মালয়েশিয়া সীমান্তে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। গত ১৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ৩টার সময়ও ৪১নং হাইওয়ের চুমপন থেকে সুরাতহানি যাওয়ার পথে তল্লাশি চালাতে দেখা যায়।
মালবাহী এসব যানের পেছনের তেরপাল উল্টে বা দরজা খুলে টর্চ মেরে দেখা হচ্ছে। চালককেও চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। বোঝা যায় এ মৌসুমে মানবপাচার ঠেকাতে বেশ কড়া অবস্থানে রয়েছে থাই সরকার।
গত বছরের অক্টোবরে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অ্যাগেইনস্ট ট্রাফিক ইন ওম্যান’র (জিএএটিডাব্লিউ) গবেষক জুন সাই তাং বাংলানিউজকে বলেছিলেন, থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ সতর্ক অবস্থায় থাকায় নতুন পথ ব্যবহার করতে পারে পাচারকারীরা, এ ধারণা থাইল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থ্যাগুলোর।
গত বছরের ৬ অক্টোবর তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, আমাদের কাছে খবর রয়েছে মায়ানমার সীমান্তে কিছু নৌকা ভাসছে।
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার আঞ্চলিক মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান সম্প্রতি রয়টার্সকে বলেছেন, যেসব এলাকায় মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটে, ওই সব এলাকায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, পাচারকারী ও সম্ভাব্য যাত্রী উভয়ই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
থাইল্যান্ডে মানবপাচার নিয়ে কাজ করছে এমন সূত্রগুলো বাংলানিউজকে জানায়, সায়া থাই, কো সায়া, সায়া নুয়া, ঠুং লা ওং, কো লি, বাং তিপ নাই নদী ধরে বাং লাং, খু রাতের মতো গহীন অরণ্যে এসে নৌকাগুলো ভিড়তো।
এছাড়া, আন্দামান সাগর ঘেষে ফুকেটের আশপাশের ফাং এনজিএ, কো ইয়াও নই, কো ইয়াও ইয়াই, ক্রাবি, কো পু’তে এসে ভিড়ে নৌকাগুলো।
এরপর ফেতকাসেম রোড ধরে কয়েকশ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন বাহন ব্যবহার করে মালয়েশিয়ার পেদাং বাসার সীমান্তে আসতো। এটা থাইল্যান্ডের ৪নং হাইওয়ে। এই পুরো পথটুকুই জঙ্গলময় স্থানের মধ্যদিয়ে চলা হাইওয়ে ব্যবহার করতো পাচারকারীরা।
তবে গত সেপ্টেম্বর থেকেই সাতুন এবং থাং বান ন্যাশনাল পার্কে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছ থাই সেনাবাহিনী এবং পুলিশ। ফলে কো-ফায়াম বা কো-চাংয়ে নামলেও ফেতকাসেম রোড ধরে উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে ওঠে পাচারকারীদের।
এক্ষেত্রে পারচারকারীরা ন্যাগো ওয়াটারফল ন্যাশনাল পার্ক বা কায়েং ক্রাং ন্যাশনাল পার্কের নং লুম ফো গহীন জঙ্গল ধরবে। এক্ষেত্রে বাত সুয়ান, চাই খা, বান সুয়ান, মোকলাফালারাম গার্ডেন ধরে ফেতকাসেম রোডের ‘মু’ এলাকা ব্যবহার করতে পারে পাচারকারীরা। এটাই ৪১নং হাইওয়ে।
সূত্র জানায়, এ গহীন অরণ্য পাচারকারীদের জন্যে পার হওয়াটা খুব সহজ হবে না। বিশেষ করে দিনের বেলা ছাড়া এটা পার হওয়া খুব কঠিন হবে। তবে বনের মধ্যের পথগুলো ব্যবহার করতে পারে তারা। ফেতকাসেম রোডে বনের পূর্বাংশ ঘেষে রয়েছে রাবার এবং পাম বাগান। এই হাইওয়েতে লোকাল পরিবহন রয়েছে। যেখানে হয়তো আর গ্রুপে না যেয়ে ৩ বা ৪ জনের দলে অভিবাসন আগ্রহীদের ভাগ করে নেবে পাচারকারীরা। দেশটির পূর্বাংশের এই উত্তর দক্ষিণ রাস্তাটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি এখন বাড়ানো হয়েছে।
সেক্ষেত্রে ৪১নং হাইওয়ে ব্যবহার করে সোজা ফাতু লুং হয়ে শংখলার পাশ ধরে হাত ইয়াইতে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালায় পাচারকারীরা।
এরপর এশিয়ান হাইওয়ে ২ ও ৪১ নং ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই মালয়েশিয়ার পেদাং বাসার বা সেদাও সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। এ কারণেই ৪১নং হাইওয়েতেই বাড়ানো হয়েছে অধিক নিরাপত্তা তল্লাশি।
দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে মানবপাচার নিয়ে কাজ করছেন বিবিসি’র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জনাথন হেড। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত মৌসুমের অভিজ্ঞতায় এবার থাইল্যান্ড সরকার বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে। পূর্বের পথগুলো পাচারকারীরা এবার ব্যবহার করতে চাইলে সেটা বেশ কঠিন হবে। বিশেষ করে রারং এলাকায় পুলিশের প্রধান বিষয়টিতে বেশ সতর্ক রয়েছেন।
এবার পাচারকারীদের নতুন পথ দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের পাচার করার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশও মানবপাচার ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের আইনি সুবিধা প্রদানকারী সংস্থা আরাকান প্রজেক্টের কর্মকর্তা ক্রিস লুয়া বলেন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এ বছর অভিবাসনের আশায় সমুদ্রে ভেসে পড়া মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার মানুষ সমুদ্র পথে যাত্রা করেছে বলে জানান লুয়া। যেখানে ২০১৪ সালে ওই সময়ে ৩২ হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিলো।
লুয়া বলেন, ‘কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করায় মানব পাচারকারীরা এখন আর থাইল্যান্ডে ঢুকতে পারছে না। যে অল্প সংখ্যক দালাল এখনও কাজ করছে, তাদের অনেকের আগে থেকেই শ্রমিক আনার ‘অর্ডার’ রয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০২২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
এমএন/টিআই