থাইল্যান্ড থেকে ফিরে: গ্রামের কথা ভাবলেই আমাদের মনে ভেসে উঠে মেঠো পথ, সবুজ ফসলের মাঠ, আম-কাঁঠালের বাগান অথবা সুপারি কিংবা নারিকেল গাছের সারি। কিন্তু যে গ্রামের কথা বর্ণনা করতে যাচ্ছি, সেটিতে এগুলোর কোনটিই নেই।
থাইল্যান্ডের ফুকেট থেকে জেমস বন্ড আইল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলাম আমরা চার সহকর্মী। সকালেই যাত্রা শুরু, থাই ড্রাইভার শত কিলোমিটার গতিতে ঘণ্টা খানেক গাড়ি হাঁকিয়ে যখন ফুকেটের উত্তরে ফাং নাগা শহরে বানরের গুহায় নিয়ে গেল, তখন বেলা পৌনে বারোটা। সেখান থেকে আমাদের সাথে যোগ দিলেন আরও অনেকে, বিভিন্ন দেশের। ঘুরে দেখলাম জেমস বন্ড ও খাই আইল্যান্ড। ভ্রমণ যখন শেষ, তখন সূর্য মাথার উপর, ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে।
আমাদের ট্যুর গাইড মেয়েটির নাম লিনা। বয়স কত হবে, তেইশ কি চব্বিশ। তার বয়সী অনেককেই দেখলাম গাইড হিসেবে কাজ করছে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে লিনা জানালো, আমাদের লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে কাছের একটি গ্রামে। আমাদের বহনকারী নৌকাটি ছুটে চললো সেদিকে।
পাথরের পাহাড়গুলোর ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলছে শক্তিশালী ইঞ্জিনচালিত নৌকা, পাশ কাটিয়ে পেছনে সরে যাচ্ছে গেওয়া আর গড়ান গাছে ভরা ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। অনেকেই ক্যামেরা কিংবা মোবাইলের ক্লিক করে ছবি তুলে নিচ্ছে সেগুলোর। কেউবা আবার সেলফি তোলায় নিমগ্ন।
পাহাড় আর বনের ফাঁক গলে নৌকাটি বের হতেই চোখ আটকে গেলো পাথরের পাহাড়ের নিচে। পানিতে ভাসছে কয়েকশ’ ঘরবাড়ি। অনেক দূর থেকে দেখা যায়, মসজিদের সোনালী রংয়ের গম্বুজগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হয়, পাথরের পাহাড়টি এই গ্রামটিকে নিজের সন্তানের মত কোলে নিয়ে আগলে বসে আছে, যেন সমুদ্রের ঢেউ কিংবা ঝড়-ঝাপটা এর গায়ে না লাগে!
লিনা জানালো আমরা চলে এসেছি। গ্রামটির নাম কোহ পানী, স্থানীয়ভাবে এটিকে পানী গ্রাম বলেই ডাকা হয়। নামটি শুনে বেশ ভালো লাগলো। মনে মনে বললাম, বাহ বেশ তো, পানির উপর পানী (PANYEE) গ্রাম।
আমাদের নৌকাটি ভিড়লো ককশিটের উপর ভাসমান এক ঘাটে। যেটি একটি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে লাগোয়া। সেখানে সবাই পা ফেলতেই সেটি দুলে উঠলো। রেস্টুরেন্টে গিয়েতো চক্ষু ছানাবড়া।
থরে থরে চেয়ার-টেবিল বসানো। সেখানে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রকমের খাবার। এক ফাঁকে গাইড লিনা জানিয়ে দিলো খাওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ের পর পাঁচ মিনিটের বেশী নৌকা কারোর জন্য অপেক্ষা করবে না। যে মিস করবে, তাকে পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে ধরে আনা তাজা মাছের খাবার। সকলেই গোগ্রাসে খেয়ে যখন লাঞ্চ শেষ করলাম, তখন হাতে লিনার দেয়া সময়ের আরও কিছুক্ষণ বাকি রয়েছে। তাই ভাবলাম, চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক গ্রামটিতে।
গ্রামটি থাইল্যান্ডের ফাং নাগা প্রদেশে। মুসলমান-প্রধান জেলেদের গ্রাম। পানিতে বড় বড় পিলার আর খুঁটি গেঁড়ে তার উপর পাটাতন বিছিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। হাজার দুয়েক মানুষের বাস এই গ্রামে। তাদের জীবিকা সমুদ্র থেকে মৎস আহরণ। গ্রামটির গোড়া পত্তন হয়েছিলো অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে, মালয়েশিয়ার জেলেদের দ্বারা।
এই গ্রামে একটি স্কুলে রয়েছে, তবে সেটি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার, এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়েই একসাথে পড়ে। ক্লাশগুলো সকালের দিকেই হয়, যাতে স্কুল শেষ করে ছেলেরা মাছ ধরায় আর মেয়েরা দোকান-পাট কিংবা রেস্টুরেন্ট সামলাতে পারে। আনুষ্ঠানিক কিংবা উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের পাড়ি জমাতে হয়ে ফাং নাগা কিংবা ফুকেটে। প্রতিকূল সামুদ্রিক পরিবেশের কারণে সন্তানরা বড় হলে তাদের পরামর্শ দেয়া হয় অন্যত্র চলে যেতে। কিন্তু অনেকেই থেকে যায়, জন্মভূমির টানে, সমুদ্রের টানে।
আর গ্রামের সেই সোনালী গম্বুজওয়ালা মসজিদটি নামাযের পাশাপাশি জেলে সম্প্রদায়ের মিলনস্থলেও পরিণত হয়েছে। কোন বিচার-সালিশ করা লাগলে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। এখানের ছোট বাজারটিতে থাই পোশাক ছাড়াও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী পাওয়া যায়। দাম নাগালের মধ্যে।
এখানে ভাসমান খেলার মাঠও রয়েছে। প্রথমে গ্রামের শিশুরা ভাঙা কাঠ ও নৌকার পাটাতন দিয়ে এটি তৈরি করেছিলো। পরে তাদের খেলাটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর নতুন করে আরও একটি মাঠ তৈরি করা হয়। আর বেশ মজার ব্যাপার হলো, পানীর গ্রামের ফুটবল দলটি দক্ষিণ থাইল্যান্ডে বেশ জনপ্রিয়।
স্মার্টফোনে বুঁদ যারা, কিংবা যারা ফেসবুকের পোকা, তাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কিরে ভাই, সমুদ্রের ভেতরের একটি গ্রাম, সেখানে গিয়ে কি নেটওয়ার্ক পাবো? কিংবা সেখান থেকে কি ফেসবুকে সেলফি আপলোড দিতে পারবো? উত্তর, হ্যাঁ, অবশ্যই পারবেন। সেখানেও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। রয়েছে থ্রিজি ও ফোরজি ইন্টারনেট সুবিধা।
আরও একটা মজার ব্যাপার হলো, এই গ্রামে মাত্র একজন পুলিশ রয়েছেন। অবশ্য তিনি সব সময়ই বেকার বসে থাকেন, কারণ এখানে অপরাধ নেই বললেই চলে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে ব্যাঙ্কক যেতে প্লেন ভাড়া পড়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সেখান থেকে ফুকেটের বাস ভাড়া পড়বে ১৩০০ টাকা। ফুকেটে থাকা-খাওয়ার খরচ খুব বেশি নয়। দুই হাজার টাকা হলেই ভালো মানের হোটেল পাওয়া যায়। হোটেলগুলোতেই বিভিন্ন দ্বীপে যাওয়ার প্যাকেজ রয়েছে। পানী গ্রামটি জেমস বন্ড আইল্যান্ড প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত। খরচ পড়বে জনগ্রতি প্রায় ৩০০০ টাকা। এই খরচেই জেমস বন্ড আইল্যান্ড, খাই আইল্যান্ড ও পানী গ্রাম ভ্রমণ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪ , ২০১৬
একেএ/জেডএম