ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

নিঃস্ব হয়ে পাওয়ার গল্প

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৫
নিঃস্ব হয়ে পাওয়ার গল্প (বাঁ থেকে) কবির বকুল, চন্দন সিনহা ও কৌশিক হোসেন তাপস/ছবি: নূর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘তুমি আছো বলে, তারা নেভে জ্বলে
সাগরেতে নদী খোঁজে মোহনা
তুমি আছো বলে বাঁচি, পৃথিবীতে আমি আছি,
তুমি অন্য কারো হতে পারো না
আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো জানো না
যখন তোমাকে পাবো না’

এই একটি গান প্রাপ্তিতে পূর্ণ করে দিয়েছে এর তিন শিল্পীকে। এটি লেখার জন্য কবির বকুল, সুর ও সংগীত পরিচালনার জন্য কৌশিক হোসেন তাপস এবং গাওয়ার জন্য চন্দন সিনহা ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

তাপস পেশাগত জীবনে সংগীতনির্ভর চ্যানেল গানবাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী। তার কর্মস্থলে বসেই তিনজন আড্ডা দিলেন বাংলানিউজের সঙ্গে।

‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ গানটি ব্যবহার হয়েছে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’ ছবিতে। কিন্তু আড্ডার শুরুতেই কবির বকুল জানালেন গানটি তৈরি হয়েছিলো অন্য কারণে। সে এক বিরাট ইতিহাস! সংক্ষেপে বলা যাক।

কবির বকুল আর চন্দন সিনহা শরীরকে সতেজ রাখতে দীর্ঘদিন একসঙ্গে সকালবেলায় রমনা পার্কে হাঁটেন। এর আগেও তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। তাপসের সুরেও তারা আগেই কাজ করেছেন। বন্ধু হলেও তাদের সম্পর্কটা আপনি আপনি। এই ত্রয়ীর প্রথম কাজ ছিলো ‘তুমি আমি চলো না’। বিলাস খানের নির্দেশনায় এর ভিডিওতে মডেল হন মাহফুজ ও সুমাইয়া শিমু।

একদিন বকুলকে চন্দন জানালেন, তাপস একটি সংগীতায়োজন করেছেন। এর ওপর গান লিখতে হবে। সুর-সংগীত শুনে মুগ্ধ হওয়ায় বকুলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাহ! কম্পোজিশনটা সুন্দর। ’ তখনও তাপসের সঙ্গে গানটি নিয়ে তার কোনো কথা হয়নি। সুরের ওপর লিখে পার্কে যাওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে চন্দনকে শোনান বকুল। তার কথায়, ‘কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা মনে হচ্ছিলো! শুরুতে লিখেছিলাম ‘আমি একা হয়ে যাবো জানো না…। ’ পরে একা শব্দটির পরিবর্তে নিঃস্ব শব্দটি বসালাম। ’

এরপর দুটি পৃথক শুক্রবারে গানটিতে কণ্ঠ দেন চন্দন। স্টুডিওতে তার ভয়েস নিয়েছিলেন বকুল। তাপস তখন ছিলেন না। এটা সাত বছর আগের কথা। গানটি অ্যালবামে প্রকাশের লক্ষ্যে তৈরি করা হয়। পরে বিটিভির ‘আনন্দমেলা’য় এটি পরিবেশন করেন চন্দন। গানটি নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন বকুল। তাই তিনি একজন পরিচালককে তার ছবিতে ব্যবহারের জন্য এটি শুনতে দিয়েছিলেন। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি। একদিন ওই নির্মাতা ফোনে জানান, গানটি চলবে না। কারণ এটি নায়কের পছন্দ হয়নি! স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হন বকুল। তবে আশা ছাড়েননি।

কয়েক বছর পর চন্দন ফোন করে জানালেন, তার বন্ধুরা ছবি বানাবেন। বকুলকে তিনি তত্ত্বাবধানের প্রস্তাব দেন। কয়েকদিন ভেবে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ ছবিতে কাজ করার জন্য তিনি রাজি হন। এখানেই তিনি ‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ গানটি কাজে লাগান। দৃশ্যধারণের পর অভিনেত্রী জয়া আহসান জানতে চেয়েছিলেন এটি কার গাওয়া। বকুল জানান চন্দনের কথা। কিন্তু জয়া এবং ইউনিটের অনেকেই এটা বিশ্বাস করছিলেন না!

কবির বকুল বললেন, ‘গানটি নিয়ে আমার অনেক আশা ছিলো। কোনো না কোনো পুরস্কার পাবে এই বিশ্বাসও মনে রেখেছিলাম। ’ নিরাশ হননি তিনি। সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার পেয়েছেন চন্দন। চন্দন কি আশা করেছিলেন জাতীয় পুরস্কার পাবেন? ‘একটা বিশেষ কারণে আশাবাদী ছিলাম। আমাকে হানিফ ভাই (হানিফ সংকেত) একদিন জানান, তার মেয়ে এই গানটি গায়। হানিফ ভাই কিন্তু কারও প্রশংসা সহজে করেন না। এজন্যই একটু আশাবাদী ছিলাম। ’  তিনি আরও বলেন, ‘এটি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। গানটির কৃতিত্ব সবার। গানের কথা আর কম্পোজিশন ভালো না হলে আমি ভালো গাইলেও কাজ হতো না। শ্রোতারা গানটি গ্রহণ করেছেন, তাই তাদেরও অবদান আছে এই প্রাপ্তিতে। ’

‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ চন্দন সিনহার পুরনো সব গানকে ছাপিয়ে গেছে । অনেকের মুঠোফোনে কল করলেও শোনা যায় এটি। তার উত্থান প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটকের শীর্ষসংগীত গেয়ে। তিনি নিজে থেকেই প্রচারের আলো এড়িয়ে চলেছেন। প্রচারবিমুখ এই শিল্পী বরাবরই আড়ালে থাকা উপভোগ করেন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডেশ্বরী পরিবারের সন্তান তিনি। নব্বই দশকের ঘটনা। গানের টানে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতের মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন তিনি। মজার তথ্য হলো, সেই সময় ভালো হিন্দি বলতেন চন্দন। হিন্দি চর্চাও করতেন। সেই হিন্দি জ্ঞান দিয়ে কিশোর কুমারকে প্রতিবার দুটি করে চিঠি লিখতেন তিনি। একসময় দেশে ফিরে আসার পর আবদুল্লাহ আল মামুনের সান্নিধ্য পেতে লেগে থাকেন তিনি। একসময় সুযোগ মেলে। ফলশ্রুতিতে তার পরিচালিত ‘শীর্ষবিন্দু’ (১৯৯৪), দেশের প্রথম ডেইলি সোপ ‘জোয়ার ভাটা’ (২০০২), ‘উত্তরাধিকার’ (২০০৩), ‘একজনমে’ (২০০৪) প্রভৃতি ধারাবাহিক নাটকের শীর্ষসংগীত গেয়ে পরিচিতি পান চন্দন। তিনি বললেন, ‘আবদুল্লাহ আল মামুনই আমার আবিষ্কারক। শিল্পী হিসেবে আজ আমার যা অর্জন তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। ’

নাটকের গান নিয়ে চন্দন সিনহার প্রথম একক অ্যালবাম ‘শীর্ষবিন্দু’ প্রকাশিত হয় সাউন্ডটেক থেকে। এরপর একে একে বেরিয়েছে ‘জোয়ার ভাটা’, ‘তোমারই ভালোবাসায়’ এবং সর্বশেষ ‘তোমাকে চাই এ বসন্তে’  (২০০৫)। মাঝে আসিফের সঙ্গে ২০০২ ‘সুখের শহরে’ নামের দ্বৈত অ্যালবামে গেয়েছেন তিনি। গত একযুগ কোনো অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেননি চন্দন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে আমেরিকায় কলা অ্যাওয়ার্ডে সবশেষ গেয়েছিলেন। ওই আয়োজনে রুনা লায়লা, মিঠুন চক্রবর্তী, জোজো, রঞ্জিত মল্লিক, কোয়েল মল্লিক ছিলেন। কনসার্ট এড়িয়ে চলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘লোকারণ্য আমার ভালো লাগে না। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি। সবসময় নিজেকে বলতাম, কম কাজ করলেও সেটা যেন ভালো হয়। এজন্য ১০ বছর ধরে অ্যালবাম করছি না। ক্যামেরার সামনে আসার ব্যপারে আমি সবসময়ই লাজুক ছিলাম, এটা এখনও আছে। তাই আমি যেটা পারি সেটা করি না। ’

চন্দনের মতো তাপসেরও এটা প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তি। রূপালি পর্দার জন্য এটাই ছিলো তার প্রথম কাজ। ৩১ বছর বয়সী এই সংগীত পরিচালকের ২৫ বছরই কেটেছে সুরের ভুবনে। মাত্র ৬ বছর বয়সে গানে হাতেখড়ি তার। তালিম নিয়েছেন শিশু একাডেমী ও ছায়ানটে। তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় আট বছর বয়সে। নিয়ত সংগীত সাধনায় রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক, লালন, হাছন বাংলার চিরায়ত ফোক কিংবা ওয়েস্টার্ন মিশেলে বাংলা ফিউশন- সব শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। বাজাতে পারেন কি-বোর্ড, পিয়ানো, গিটার কিংবা বাঁশি। তার সংগীত পরিচালনায় জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, বিপ্লব, পথিক নবী, কানিজ সুবর্ণা, তিশমা, আঁখি আলমগীর, রিজিয়া পারভিন, রবি চৌধুরী গেয়েছেন। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অনুভূতি তাপস বলেন, ‘চলচ্চিত্রের ওপর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান জাতীয় পুরস্কার পেয়ে আমি খুব আনন্দিত। এ সম্মান আমাকে আমার কাজের প্রতি আরও দায়িত্বশীল এবং আরও যত্নবান হতে সহযোগিতা করবে। গানটির গীতিকার কবির বকুল এবং গায়ক চন্দন সিনহাও পুরস্কার পাওয়ায় আমি খুশি। ’

চন্দন ও তাপস প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পেলেও এ নিয়ে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা গীতিকার হলেন কবির বকুল। এর মধ্যে আছে হ্যাটট্রিকও। ২০০৮ সালে নার্গিস আকতারের ‘মেঘের কোলে রোদ’ ছবির ‘বলো না কেন ওই আকাশ নেমে আসে সাগরের বুকে’, পরের বছর পিএ কাজল পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রীর ওয়াদা’র ‘একটা চাঁদ ছাড়া রাত আঁধার কালো’ এবং ২০১০ সালে বদিউল আলম খোকনের ‘নিঃশ্বাস আমার তুমি’ ছবির ‘রুপালি চাঁদ নেমেছে’ গান লেখার জন্য জাতীয় পুরস্কার পান তিনি।

২৮ বছর ধরে গান লিখছেন কবির বকুল। তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে অধিকাংশই জনপ্রিয়। তিনি লিখলেই যেন হিট! এর রহস্য কী? হেসে উত্তর দিলেন তিনি, ‘আমি লিখলেই হিট হয় তা পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রচুর কাজ করলে তার মধ্য থেকে অবশ্যই ভালো কিছু বের হবে। নির্মাতারা আমার ওপর আস্থা রাখায় প্রচুর গান লেখার সুযোগ পেয়েছি। তাই হয়তো কিছু জনপ্রিয় গান বেরিয়েছে। কাজ করার সুযোগ পাওয়াটাই বড় কথা। ভালো ছবি আর ভালো সুর হলে মানুষের হৃদয়কে সহজেই স্পর্শ করে গান। এ ক্ষেত্রে আমি সৌভাগ্যবান যে, আমার লেখা গানগুলোর ওপর ভালো সুর বসেছে, শিল্পীরাও ভালো গেয়েছেন। চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিক ব্যাপার থাকে, তাই এটা বুঝে কাজ করলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে। কোন পরিস্থিতিতে কেমন গান প্রয়োজন তা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি। সেভাবেই কাজ করি। আর নিজেকে আমি সবসময় তরুণদের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করি। ’ 

দেশের প্রায় সব প্রজন্মের শিল্পীরা কবির বকুলের লেখা গান গেয়েছেন। প্রয়াত সুরকার আবু তাহেরের সুরে ১৯৯৪ সালে ‘অগ্নিসন্তান’ ছবিতে প্রথম গান লেখেন তিনি। প্রথম লেখা গানের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কারে সেরা গীতিকারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। সংগীতাঙ্গনে তাকে পথ চলতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী। তার মাধ্যমেই বকুলের সঙ্গে পরিচয় হয় চন্দনের। তিনি বললেন, ‘সেটা ২০ বছর আগের কথা। একদিন তপন দাদার সঙ্গে দেখ‍া করতে গিয়ে বকুলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মনে আছে, বকুল সেদিন একটি সাদা শার্ট পড়েছিলেন। ’ বকুল আর চন্দন সমবয়সী হলেও তাপস তাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট। তবে তার প্রতিভার প্রশংসা করলেন দু’জনই।

নতুন খবর হলো, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী টু’ ছবিতেও এই ত্রয়ীর একটি গান রয়েছে। এর শিরোনাম ‘প্রেম করবো প্রেমে পড়বো’। এবারও একটা কিছু হয়ে যাবে বলে আশা ঝরলো তাদের কণ্ঠে।

* ‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ গানের ভিডিও :


* চন্দন সিনহাকে নিয়ে প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুনের কথা :


বাংলাদেশ সময় : ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ