ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

‘আমি মানিয়ে নিতে পারি’

খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
‘আমি মানিয়ে নিতে পারি’ সুষমা সরকার/ ছবি: নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভীষণ চুপচাপ। কথা বলেন, মনে হয়, যেন শব্দ গুণে গুণে! সুষমা সরকারের অভিনয়ের ক্ষেত্র অনেক- মঞ্চ, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র।

নাট্যতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা রয়েছে। এক বিকেলে বাংলানিউজ কার্যালয়ে বসে আলাপ জমলো সুষমার সঙ্গে।

বাংলানিউজ : ‘ভুবনমাঝি’ বলে যে চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হলেন সম্প্রতি, ফেব্রুয়ারি থেকে দৃশ্যধারণ শুরু হবে বলে শোনা যাচ্ছে; সেটার গল্প তো শুরু হচ্ছে ১৯৭১ সাল থেকে, নাকি?

সুষমা : একাত্তর থেকে।

বাংলানিউজ : তার মানে পিরিওডিক্যাল একটা ব্যাপার স্যাপার তো থাকছেই আপনার চরিত্রে- কথায়, চলায়। যতোটুকু শোনা গেছে, আপনি ছবিতে একজন সেবিকা।

সুষমা : হ্যাঁ। এটি সত্যি চরিত্র কিন্তু। যতোগুলো চরিত্র আছে এ ছবিতে, সবই বাস্তবের। ভুবনমাঝি যে লোকটা, সে বেঁচে আছে এখনও।

বাংলানিউজ : ‘ডুবসাঁতার’, সেখান থেকে ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’, তারপর ‘ছুঁয়ে দিলে মন’। নতুন করে যোগ হলো ‘ভুবনমাঝি’। এই-ই তো আপনার ফিল্ম ক্যারিয়ারগ্রাফ আপাতত। এই ছবিগুলোকে কেন আমরা একেবারেই সুষমার ছবি বলতে পারছি না?

সুষমা : বলা যাচ্ছে না কারণ... আমার চরিত্রগুলো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিস্থিতি খুব... যদি বলি তিন ঘণ্টার একটি ছবিতে আমার উপস্থিতি কতোটুকু...

বাংলানিউজ : আমরা কি তাহলে এটা বলবো, সিনেমা নিয়ে আপনার আলাদা করে চিন্তাভাবনা আছে এমনটা না? এমনটা না যে, সিনেমা করতেই হবে, বা এ রকম কিছু?

সুষমা: আমি তো ক্যারেক্টার আর্টিস্ট- সোজা কথা। নায়িকা হতেই হবে এমন মনে হয়নি কখনও। নাটকে বলো অথবা সিনেমায়, যেখানে আমার মনে হয়েছে- এখানে একটু ভালো করার সুযোগ আছে, চেষ্টা করেছি করার।

বাংলানিউজ : ক্যারেক্টার আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে দেওয়ার কিন্তু অনেক ঝক্কি আছে। অনেককিছু মেনে নিতে হয়। যেমন ধরেন, চরিত্রের ব্যাপ্তি। এটা নিয়ে তো অন্যদের মাথা খারাপ হয়ে যায়! ক্যারেক্টারে কয়টা সিন আছে- এটাই ভাবে আগে অনেকে। কিন্তু ওসব চিন্তা না করে, শুধু চরিত্রটা কেমন- এটা নিয়ে মনোযোগী হওয়ার শিক্ষাটা আপনার ওই নাট্যতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা থেকে এলো কিনা খানিকটা?

সুষমা : ওখান থেকেই এসেছে। এরকম চিত্রনাট্যও আমি পাই। যেখানে ধরো, অনেক অংশ জুড়েই আমি আছি। কিন্তু চরিত্রটির কোনো ভ্যালু নেই, নতুনত্ব নেই। ওটা করতে আমার ইচ্ছা হয় না। অথবা ধরো, ওই চিত্রনাট্যেই আরেকটা চরিত্র আছে, যেটার ব্যাপ্তি কম। কিন্তু অভিনয়ের জায়গা আছে, নতুনত্ব আছে, আমি ওটাই করতে চাইবো।

বাংলানিউজ : মঞ্চে কাজ করছেন তো?

সুষমা : এখন করছি না।

বাংলানিউজ : সময় দিতে অসুবিধা হয়?

সুষমা : অসুবিধা হলো গিয়ে যাতায়াত। শিল্পকলা পর্যন্ত যেতে-আসতে আমাকে প্রায় পুরোদিন ব্যয় করতে হয়। জ্যামের কথা যদি চিন্তা করো! যেহেতু পরিবার-বাচ্চা এসব নিয়েও থাকতে হয় আমাকে। কাজের বাইরে আমি খুবই ফ্যামিলি ওরিয়েন্টেড। কারণ শেষ পর্যন্ত আমাকে ঘরেই ফিরতে হবে। ফ্যামিলি যদি না থাকে তাহলে কিন্তু আমি থাকি না। সারাদিন তো আর অ্যাকটিং করে বেড়ালে চলবে না।

[পরিবার থেকে প্রসঙ্গ ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে ‘সময় যে বদলে গেছে’ সেটার বিশ্লেষণে চলে যায়। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন সুষমা। তার নিজের জন্যও বরাদ্দকৃত একটু সময়ের যে প্রচন্ড অভাবের দিনকাল চলছে- সেটা বলেন খুব নিচু স্বরে। তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। শীতকাল এলে এই নষ্টালজিয়া খোঁচায় খুব। অলস বসে রোদ পোহানো, শিউলি ফুল কুড়ানো ভোর বেলা- যান্ত্রিকতা গিলে ফেলেছে মুহূর্তগুলো!]

বাংলানিউজ : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কি আপনার জীবনের ভেতরের সৌন্দর্যকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করলো?

সুষমা : অবশ্যই। এছাড়া আমার বাবা তো সরকারি চাকরি করতেন। বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন, থেকেছেন। আমিও ঘুরেছি সেই সূত্রে, থেকেছি। বাংলাদেশের অনেক জায়গাই আমার দেখা।

বাংলানিউজ : তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হচ্ছেন, তখনই যে আপনার প্রথম বাইরে আসা এ রকম না?

সুষমা : না না। আমি অনেক ঘুরেছি। সেই অর্থে আবার ধরো, যেটা আমার কলেজ ছিলো- ভারতেশ্বরী হোমস, ওটা আলাদা একটা জগত। ছোট্ট একটা জগত। ওইখানে মনে হবে, এটা আলাদা একটা দেশ। ওইখানের নিয়ম-নীতি। ওই জায়গা থেকে প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো। আমি আসলে অনেক খোলা মনের মানুষ। যদিও আস্তে আস্তে পরের দিকে ভালো লেগে গিয়েছিলো।

বাংলানিউজ : আপনার যে এই নাটক নিয়ে পড়াশোনা, থিয়েটার চর্চা। পরবর্তীতে যখন টিভি নাটকে অভিনয় করতে এলেন, শেখার সঙ্গে ব্যবহারিকের জায়গায় কোনোরকম দ্বন্দ্ব হলো কি-না?

সুষমা : সে তো হয়-ই। অন্যদের কথাও যদি বলি, যারা থিয়েটার করেন, থিয়েটারে যখন একটা ক্যারেক্টার পোট্রেট করা হয়, তখন কিন্তু শিল্পী ওই চরিত্রটির সঙ্গে বসবাস করে। জার্নি করে। কিন্তু আমি যখন টেলিভিশনে কাজ করছি, তখন ওই চরিত্রে বিলং করছি না। যতোই বলি যে, আমি স্টাডি করছি, এটা সেটা করছি- সেটা হয়-ই না। কীভাবে সম্ভব! এতো কাট কাট মিডিয়াতে তুমি ইমোশনটাকে ধরে রাখতে পারবে না, সম্ভবই না। বারে বারে তুমি বেরোচ্ছো, বারেবারেই ঢুকছো। ওই যে মজা, মানে চরিত্রের ভেতরে বসবাসের যে মজা, সেটা টিভি নাটকে পাওয়া যায় না। হয়তো একটা শটে পাওয়া যেতে পারে, একটা দৃশ্যে পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু অলওভার একটা জার্নি? ভেরি ডিফিকাল্ট!

বাংলানিউজ : তাহলে ওই দ্বন্দ্ব থেকে উৎরে ওঠেন কীভাবে? সমঝোতার জায়গাটায় আসেন কীভাবে?

সুষমা : আমার আসলে মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। আমি মানিয়ে নিতে পারি।

বাংলানিউজ : আপনার বড় হয়ে ওঠার ভেতরে কি এই মানিয়ে নেওয়া ছিলো?

সুষমা : হ্যাঁ। জীবন থেকে নেয়া বলতে পারো।

বাংলানিউজ : এটা কী এমন ছিলো যে, নারী বলে মানিয়ে নেওয়াগুলো শিখে নিতে হয়েছে?

সুষমা : না। নারী হিসেবে না। একজন নারী হিসেবে আমি কখনই মানিয়ে নিতে চাই না।

বাংলানিউজ : আপনার জন্ম কোথায়?

সুষমা : মীর্জাপুরে। মামার বাড়িতে।

বাংলানিউজ : আপনি কি বড় হচ্ছেন ওখানেই?

সুষমা : না। বললাম না যে, আমার বড় হয়ে ওঠা অনেক জায়গা মিলিয়ে। প্রত্যেকটি জায়গায় দু’বছর তিন বছর করে থেকেছি। এটাও একটা বিষয় কিন্তু। আমার বন্ধু মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। এটার মধ্যেও কিন্তু একটা মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার আছে। ছোটবেলা থেকেই, বন্ধুত্ব মাত্র গড়ে উঠছে, আমাকে তখন ওই এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে। আবার ওখানে গিয়ে আমার নতুন করে শুরু।

বাংলানিউজ : তখন তো এমন না যে, ফোন করে খোঁজখবর করা যেতো...

সুষমা : একেবারেই না। এমনকি জানিও না এখন কে কোথায় আছে!

বাংলানিউজ : কষ্ট হতো না?

সুষমা : খুব। এমনকি কান্নাকাটিও করেছি পর্যন্ত। সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে যেতাম, এবং আমি কখনই আমার জিনিস প্যাকেজিং করতাম না। মন খারাপ হয়ে যেতো। এতো বন্ধু ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি!

বাংলানিউজ : তখন কি মনে হতো যে, বাবা সরকারি চাকরিটা না করলে ভালো হতো?

সুষমা : মনে হতো, আবার হতোও না।

বাংলানিউজ : আপনার স্বামী কী করেন?

সুষমা : ইন্টেরিয়র করে। ওর একটা নিজস্ব ফার্ম আছে। স্বাধীনচেতা মানুষ।

বাংলানিউজ : মানে আপনার বড় হয়ে ওঠার ভেতরে যে সরকারি চাকরিকেন্দ্রীক একটা বিচ্ছিন্নতা, এটার কারণেই কী জীবনসঙ্গী হিসেবে এ রকম একজন স্বাধীনচেতা মানুষকে ভালো লাগলো?

সুষমা : না। ওর প্রফেশন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। ওই লোকটাকেই আমার পছন্দ। ওর কথা, ওর মানসিকতা। একটা মেয়েকে ভিন্নভাবে দেখা, দেখার দৃষ্টি...


বাংলানিউজ : যখন বিয়ে করলেন, তখন তো আপনি কাজ করছেন?

সুষমা : হ্যাঁ। তখন অল্প কাজ করছি। প্রফেশনালি নিইনি। তখন থিয়েটার ওরিয়েন্টেড মানুষগুলোর সঙ্গেই কাজ করি। বাইরে যোগাযোগটা ছিলো না। আসলে অনেক ব্রেক দিয়ে দিয়ে কাজ করা তো আমার। আমি কিন্তু এখানে অনেকদিন। প্রায় বারো বছরের বেশি। প্রথমদিকে আমি শখের বশে করেছি। তারপর তো বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের পরে আবার কাজ শুরু করলাম। তখন আমার ওই নারী নির্যাতন বিরোধী বিজ্ঞাপনটা এলো। ভালোই আলোচনায় এসেছিলাম। পরে আমার বাচ্চা হলো। গ্যাপ তৈরি হলো। তারপর আবার শুরু করলাম।

বাংলানিউজ : টিভি নাটক শুরু করেছেন তো গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় দিয়ে?

সুষমা : হ্যাঁ। ‘সাদা মেঘের বৃষ্টি’ ধারাবাহিক দিয়ে।

বাংলানিউজ : তিনি যখন ‘মনপুরা’ বানালেন, তখন আফসোস হয়নি যে আপনাকে নিলেও পারতেন?

সুষমা : না। তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু চরিত্র মনে হয় যে, হতে পারতো! এ আফসোস তো থাকবেই। যে কেনো শিল্পীরই এটা থাকে।

বাংলানিউজ : আপনার মাথায় গল্প আসে?

সুষমা : আসে মাঝে মধ্যে।

[তারপর ‘আপনি নিজেই তো একটা গল্প’ বলে দিলে তিনি স্বীকার করে নেন। বলা হয়, ‘এই গল্পগুলো নিয়ে তো নাটক-টেলিছবি হতে পারে’- সেটাও মেনে নেন। এমন তো ইচ্ছা থাকতেই পারে এ অভিনেত্রীর, যে একদিন তিনিও ক্যামেরার পেছনের মানুষটি হয়ে যাবেন। নির্মাণ করবেন। ওই ইচ্ছাটা আসলেই আছে কি-না, জানতে চাওয়া হয় প্রসঙ্গ ধরেই। ]

বাংলানিউজ : তাহলে গল্পগুলো আপনি বানান। বানাবেন?

সুষমা : না। বানাবো না। এটা আমার দ্বারা হবে না জীবনেও। ওই সাহস আমি করবো না। লেখা হয়তো যায়। নির্মাণ অনেক জটিল লাগে। এতোকিছু ম্যানেজ করে কাজ করা!

বাংলানিউজ : সিনেমায় ফিরি। ‘ভুবনমাঝি’তে। আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি আছে?

সুষমা : প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। আমাদের মেকাপ-গেটাপ কেমন হবে- ওটা নিয়ে আলাদা প্রস্তুতি চলছে। শুটিংয়ে যাওয়ার আগে রিহার্সেল হবে।

বাংলানিউজ : এখানে পরমব্রত, অপর্ণা- এরা আছেন। আপনি বলছেন যে, আপনার চরিত্রটি একাত্তর সালের। ওই সময়ে কি পরমব্রত-অপর্ণা এ দু’জনও থাকছেন?

সুষমা : হ্যাঁ। এরাও আছেন, মানে, পরমব্রত থিয়েটার করে। যুদ্ধ তার ভালো লাগে না। খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ। আর অপর্ণার নাম হচ্ছে ফরিদা। পরমব্রতের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে ওই মেয়ের অবদান অনেক।

বাংলানিউজ : শেষ প্রশ্নে ব্যক্তি আপনার কাছেই ফিরে আসি আবার। আপনি তো বন্ধুত্বের বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। এখন আপনার বন্ধু কারা?

সুষমা : আমার আসলে এখন অনেক বন্ধু। যেমন, গল্পের স্কুলের মায়েরা আমার বন্ধু। ভাবী কালচার আমাদের মধ্যে নেই। একজন আরেকজনের নাম ধরে ডাকি। অন্যরা দেখে খুব অবাকই হয়। আর আমার জাহাঙ্গীরনগরের বন্ধুরা তো আছেই।

গল্প কি আর শেষ হয়! সে তো স্রোতের শ্যাওলার মতো। ভেসে ভেসে চলে যায় কোথায় কোথায়! সুষমার সাত বছরের মেয়েটার নামও কিন্তু গল্প!

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
কেবিএন/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ