ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

হিমালয়ের চূড়ায় স্বপ্নের যাত্রা

মোহাম্মদ আজহার, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০২৩
হিমালয়ের চূড়ায় স্বপ্নের যাত্রা ...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: কনকনে হাড় কাঁপানো শীতে নিজেকে বাঁচানো যেখানে দায়, সেখানে বছরজুড়ে পরিকল্পনা হিমালয়ের শহর দার্জিলিং-সিকিম যাওয়ার। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর বিদেশ যাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর।

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস থেকে রওনা হয় সবাই। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের উদ্দেশ্যে ২০ জনের যাত্রা। মাঝপথে দুপুরে খাবার হয় দাউদকান্দির এক হোটেলে।  

সেখানে নামাজ শেষে আবার গাড়িতে। সন্ধ্যা ৬টায় নির্ধারিত সময়ের আগে স্টেশনে পৌঁছে সবাই। ৭টায় শুরু হয় চেকিং। লাইন ধরে সবধরনের চেকআপ শেষে রাত ৯টায় জলপাইগুড়ির ট্রেন ধরে ইন্ডিয়ার পথে যাত্রা। টিকিট সংকট থাকায় ভিন্ন ভিন্ন বগিতে সিট পড়েছে সবার। কয়েকটা স্লিপার কোচ থাকায় সিনিয়ররা সেখানে ছিলেন। ট্রেনের মধ্যেই রাতের খাবার শেষে সময় কাটানোর জন্য কমবেশি সবাই লুডু খেলেছে। মাঝেমধ্যে একজন অন্যজনের বগিতে ঘুরে ঘুরে আড্ডা দিয়েছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের গতিও বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েন ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী।  

সকাল ১০টায় জলপাইগুড়িতে পৌঁছে ট্রেন। সেখানে আরও একবার চেকআপ হয়। এরপর সর্বপ্রথম দেশে ফেরার জন্য অগ্রিম টিকিট কাটতে দলবল নিয়ে স্টেশনের দিকে ছুটে যাওয়া। পাশাপাশি টাকাগুলো এক্সচেঞ্জ করে ইন্ডিয়ান রুপি করা হলো। যদিও দেশে ফেরার অগ্রিম টিকিট পাওয়া যায়নি। পরে তিনটি গাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি চলেছে ঘণ্টাখানেক। অল্প কিছুদূর যেতেই মনে হলো দেশের দর্শনীয় স্থান সাজেক-বান্দরবান পাহাড়ের রাণী খ্যাত দার্জিলিংয়ের তুলনায় খুব সাদামাটা জায়গা। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িগুলো রীতিমতো শুধু উপরের দিকেই উঠছিলো। মাঝপথে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া হয়। দেশের বাইরে এটাই অনেকের প্রথম খাবার। যদিও এমন পরিমিত খাবারে কারোই পেট ভরেনি তখন।  

দার্জিলিং পৌঁছানোর আগে কার্শিয়ং নামক স্থানে নেমে চলে ফটোসেশন। সন্ধ্যায় দার্জিলিংয়ে পৌঁছে গাড়ি। গাড়িতে কাটানো এই তিন-চার ঘণ্টা সময় বেশ উপভোগ্য ছিলো। দিনের বেলায় কোথাও তীব্র রোদ আবার কোথাও ঘন কুয়াশার দেখা মিলেছে। এছাড়া বেশ কয়েকবার গাড়িতে বসেই দেখার সুযোগ হয়েছে পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী বাষ্পচালিত দার্জিলিং হিমালয়ান রেল ‘ট্রয় ট্রেন’। চাইলে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং অবধি এই ট্রেনেই আসা যেত। তবে সময় বাঁচানোর জন্য এখানে গাড়িতেই আসে বেশিরভাগ মানুষ। রাস্তার পাশ দিয়ে ছোটো-ছোটো ট্রেনগুলো অন্যান্য গাড়ির মতই স্বল্পগতিতে চলে। এখানে ট্রেনের জন্য অন্য গাড়িগুলোকে জ্যামে বসে থাকতে হয় না। একপাশে ট্রেন চলছে, আরেক পাশে চলছে গাড়ি।  

ভ্রমণ মৌসুম হওয়ায় দার্জিলিংয়ে একসঙ্গে ২০ জনের জন্য হোটেলে রুম পাওয়াটা একটু কঠিন। তাই কয়েকজন হোটেল ঠিক করতে যায়, আর বাকিরা শহরের মাঝপথে দাঁড়িয়ে কনকনে শীতে আড্ডা দেয়। তাপমাত্রা তখন তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন আবহাওয়ায় কতক্ষণইবা টিকে থাকা যায়? তাও আবার ভিনদেশি সবাই। আশপাশের সুন্দর শহরটা ঘুরে দেখারও সুযোগ নেই। কারণ একবার বিচ্ছিন্ন হলে এখানে হারিয়ে যেতে হবে। তাই সবাই কয়েকঘণ্টা ধরে এক জায়গাতেই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর হোটেল ঠিক হয়।  

৩০ ঘণ্টার জার্নির পর হোটেলের রুমগুলো পেয়েই যেন রাজ্যের স্বস্তি। প্রতিরুমে তিনজন করে থাকতে হবে। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য খুঁজতে হবে বাঙালি খাবার পাওয়া যায় এমন হোটেল। দার্জিলিংয়ে রাত ৯টার পর দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটু তাড়াহুড়ো করেই বের হতে হয় খাবারের জন্য। একটা মুসলিম হোটেল খুঁজে পেলেও বিশজনের খাবার পেতে বেগ পোহাতে হয়েছে। খাবার শেষে সামান্য কেনাকাটা করে ক্লান্ত শরীরে রুমে ফিরেই ঘুম।  

পরদিন ভোর ৬টায় দার্জিলিংয়ের সর্বোচ্চ চূড়া টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে রওনা। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের উচ্চতম স্টেশন ‘ঘুম’ শহরের সর্বোচ্চ বিন্দু এই টাইগার হিল। এখান থেকে মাউন্ট এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের দৃশ্যপট দৃষ্টিগোচর হয়। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিদিক। একটু দেরি হওয়ায় ওসব আর দেখার সৌভাগ্য হলো না। তবে তুষারপাতের মত কুয়াশা আর কনকনে শীতের মধ্যেও ফটোসেশান চলে ২০ মিনিটের মতো। একেকজন একেক ভঙ্গিতে ছবি তুলছিলো। সবার একসঙ্গে আকাশের ওড়ার চেষ্টা ক্যামেরাবন্দি করেছে অন্যকেউ।

টাইগার হিলে গ্রুপ ছবি তুলে বাতাসিয়া লুপের উদ্দেশ্যে রওনা। মাঝপথে পাহাড়ের কোলে সারি সারি গাছের মাঝে আরও একবার ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। বাতাসিয়া লুপে পৌঁছে সকালের নাস্তা সেরে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ মেলে। সেখানে নেপালী পোশাক ভাড়া দেওয়া হয়। এ পোশাক গায়ে জড়িয়ে নানান ভঙ্গিতে অনেকে ছবি তুলছে। এরপর রক গার্ডেন ঘোরার পালা, পথিমধ্যে দার্জিলিং চা বাগানের পাশেও ফটোসেশন হয়। সেখান থেকে তাজিংডন ঘুরে একটি গাড়ি মন্দিরের দিকে গেলেও রাস্তায় জ্যাম থাকায় অন্য গাড়িটি নির্ধারিত খাবারের হোটেলে চলে আসে। সেদিনের মতো ঘোরাফেরা শেষ। বিকেল থেকে সবাই দার্জিলিং শহর ঘুরে কেনাকাটায় ব্যস্ত। বিশেষ করে চায়ের জন্য বিখ্যাত দার্জিলিং থেকে সবাই বিভিন্ন ধরনের কমবেশি চা-পাতা কিনেছে। এছাড়া সিকিমের তীব্র শীত মোকাবিলা করতে অনেকে ভারি জামা কাপড়ও কিনেছে।

পরদিন সকালে দার্জিলিং ছেড়ে সিকিমের উদ্দেশ্যে রওনা। সিকিমের সৌন্দর্য দেখতে কম বেগ পোহাতে হয়নি। প্রবেশপথে ঘণ্টাখানেক লেগে যায় সেকেলে পদ্ধতিতে সবার পাসপোর্ট এন্ট্রির কাজে। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে পৌঁছে হোটেল ঠিক করতে এবার আর সময় লাগেনি বেশি। হোটেল থেকে বেরিয়ে গ্যাংটকের ঝলমলে শহর এমজি মার্গ ঘুরে ঘুরে দেখছে সবাই। সেখানেও রীতিমতো একটি বাঙালি হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা হয়। পরিচ্ছন্ন শহরটা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই আলোকোজ্জ্বল শহরে পরিণত হয়। এই শহরে গাড়ি নেই। মানুষের কোলাহল নেই। কারও সঙ্গে কারও দ্বন্দ্বও চোখে পড়ে না। শহরের মাঝে থাকা চেয়ারগুলোতে বসে ছবি তুলছে মানুষ। দর্শনার্থীদের ছবি তোলার প্রতিযোগিতা বোধহয় এখানেই সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যায় রঙিন শহরটা ফ্রেমবন্দি করতে বিভিন্ন উপায় খুঁজছিলো সবাই। এই যেমন- কফি খেতে খেতে গ্রুপ ছবি, একসঙ্গে হাঁটার ছবি কিংবা নিজের সিঙ্গেল ছবি। এ সময়গুলো হয়তো ফিরে আসবে না। কিন্তু ছবিগুলো দেখে স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে গ্যাংটকের দিনগুলো।

গ্যাংটক থেকে অনেকে কেনাকাটা করছে। এরপর রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরেই শুরু হয় র‌্যাফেল ড্রয়ের পর্ব। পঞ্চাশ টাকা ধার্য করা হয় টিকেট মূল্য। পাঁচজনকে পুরস্কৃত করা হয় এতে। র‌্যাফেল ড্র শেষে গান-বাজনায় মেতে ওঠে সবাই। অসাধারণ এই পর্বটি শেষ হয় রাত ১২টায়। এরপর সবাই নিজেদের রুমে ফিরেই ঘুম।  

অবশ্য পরদিন সকালে যেতে হবে ভারতের অর্গানিক রাজ্য খ্যাত সিকিমের দর্শনীয় স্থান ‘লাচুং’। বরফের এ রাজ্যে মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়ায় টিকিট কাটা সত্ত্বেও যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না সবার। তাই একরাশ হতাশা নিয়ে সেদিনই শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা। পুরো বাস রিজার্ভ করে শুরু হয় সাত ঘণ্টার ভ্রমণ। শিলিগুড়ি পৌঁছে টিকিট কেটে আবার কলকাতার পথে যাত্রা। ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় গাড়িতেই কেটেছে। কলকাতার বাসেও কেটে গেছে পুরো একরাত।  

পরদিন সকালে কলকাতায় পৌঁছে সেদিনই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু বছরের শেষদিন হওয়ায় সেদিন আর দেশের টিকিট মেলেনি। তাই একদিন থাকতে হবে কলকাতায়। বছরের শেষ দিনটাও কলকাতাতেই কাটলো। একদিন বেশি সময় পাওয়ায় সবাই কমবেশি কলকাতায় শপিং করেছে। দিনটা স্মরণীয় করে রাখতে সেই রাতে বিরিয়ানি খাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন সকালে শেষবারের মতো মার্কেটিং করে বেলা ১২টায় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা। অনেকদিন পর দেশের কোনও পরিবহনে চড়ার স্বাদ পাচ্ছে সবাই। এতেও আছে অন্যরকম এক তৃপ্তি।

যেভাবেই হোক স্বপ্নের বিদেশ ভ্রমণ শেষের পথে। তাই মনটা একটু ভারিই বলা যায়। বেনাপোল বর্ডারে এসে দীর্ঘ চেকআপ শেষে ১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ২০ জনের এ ক্লান্ত বহর। ফরিদপুর এসে শেষবারের মতো ভ্রমণের খাবারটাও হয়ে গেছে। এরপর বাসে উঠে গানের তালে তালে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা। তারপর সবাই ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝপথে অনেকে অনেক জায়গায় নেমে গেছে। ২ জানুয়ারি ভোর ৬টায় সবাই পোঁছে চট্টগ্রাম। যেখান থেকে ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল যাত্রা, সেখানেই শেষ হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ।  

এ যাত্রায় লেখা হাজারো গল্পকথা চির অম্লান হয়ে থাকবে স্মৃতির পাতায়। কুড়িজনের গল্পটা, যদি মনে পড়ে বছর কুড়ি পর!

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০২৩
এমএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।