কক্সবাজার থেকে ফিরে: নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সাগরের নীল জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনেরে সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ বিরাজ করছে শেষ পৌষে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ সমুদ্র সৈকত দেখতে শীতকালের ভিড়টাই সবার কাছে বড় হয়ে ধরা পড়ে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় থাকেন এই সময়েরই। হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এখানকার বিচ বাইক, অটোরিকশা এমনকি রিকশাচালক পর্যন্ত সবার অপেক্ষা বছরের শীতকালের এই জমজমাট মৌসুমটির। একটু বাড়তি রোজগারের আশায় অনেকেই করেন বাড়তি বিনিয়োগও।
ছুটি বা উৎসবে অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমণে যান। বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে পুঁজি করে হয়রানি এবং ভোগান্তিও ধারণ করেছে চরম আকারে। পরিকল্পনার অভাব এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের আনন্দ অনেক সময় চরম ভোগান্তিতে পরিণত হয়। একটু অসতর্ক হলেই ঠকতে হয় পর্যটকদের!
পর্যটকদের আনন্দ-বিনোদন, থাকা, খাওয়া ও ঘোরাফেরাকে পুঁজি করে গলাকাটা বাণিজ্য করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আর তাদের জন্য বদনাম হয় কক্সবাজারের সৎ ব্যবসায়ীদের। পর্যটন মৌসুম শুরু হলেই হোটেল-মোটেল, গাড়ি পার্কিং, যাতায়াত, দ্রব্যমূল্য ও খাবার রেস্তোরাঁসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আদায় করা হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার প্রতিবাদ করলে অনেক সময় দুর্ব্যবহারের শিকারও হতে হয় পর্যটকদের।
সরেজমিনে এই ছোট্ট শহর ঘুরে দেখা যায়, পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজারের অটোবাইক, রিকশাচালক ও রেস্টুরেন্ট সব জায়গায় গলাকাটা বাণিজ্য চলে। ছোট-বড় আবাসিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজে আদায় করা হয় যেনতেন ভাড়া। এতে করে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা হয়রানি ও প্রতারিত হচ্ছেন।
হোটেল-মোটেল জোনে ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটন মৌসুমে হোটেল-মোটেলে প্রকাশ্যে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। তারকা মানের হোটেল ছাড়া অন্যান্য হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজে ইচ্ছেমতো কক্ষ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। রুমের স্বল্পতার অজুহাতে হোটেল-মোটেলগুলোর রুম ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে। আগে যে রুম ভাড়া এক থেকে দুই হাজার টাকা ছিল, তা পর্যটন মৌসুমে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
বিশেষ করে কলাতলী কেন্দ্রীক দালালদের দখলে আবাসিক হোটেল ব্যবসা। এ দালালচক্র নিজেদের লোক আসার কথা বলে হোটেলের রুম বুকিং দেয়। চড়া দামে পর্যটকদের কাছে রুম ভাড়া দিতেই দালালচক্র এ কৌশল নেয়।
টানা ছুটির দিনগুলোর আগেভাগে দালাল চক্রের লোকজন নিজেদের নামে প্রত্যেকে ৮/১০টি করে হোটেল কক্ষ বুকিং করে রাখেন। এতে এক ধরনের কৃত্রিম সংকটও তৈরি হয়। পরে আগত পর্যটকরা হোটেল কক্ষ বরাদ্দ না পেয়ে দালাল চক্রের লোকজনের কাছে দ্বারস্ত হতে বাধ্য হন। অনেক সময় হোটেলে ঠাঁই না হওয়ায় আগত পর্যটকদের রাত্রিযাপন করতে হয় যাত্রীবাহী বাস এমনকি সৈকতের খোলা আকাশের নিচে! তীব্র শীতে এমন ঘটনা সচরাচর না দেখা গেলেও আশ্বিন-কার্তিকে যারা সমুদ্র সৈকতে গেছেন, তারা এমন দৃশ্য দেখেছেন।
একইভাবে খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্টগুলো পর্যটকদের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা আদায় করছেন। কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, জোন, বিচ এলাকা, ইনানীসহ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন স্থানে যে চার শতাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে এর মধ্যে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য।
পর্যটকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন রিকশা ও ইজিবাইক চালকরা। শহরের কলাতলী মোড় থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ইজিবাইক ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা আদায় করা হয়। যদি কেউ একা যান তাহলে ৩০-৪০ টাকা ভাড়া নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রিকশা ও ইজিবাইক চালকরা নিচ্ছেন ১০০-১৫০ টাকা। ‘অনেক দূরের পথ’ এমন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আদায় করছেন অতিরিক্ত ভাড়া। সুগন্ধা বিচের খুব কাছের হোটেল থেকে সেখানে যেতে একজন পর্যটককে রিকশায় ১৫-২০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও ৫০ টাকার নিচে কেউ যান না।
এদিকে কক্সবাজার শহরের অলিগলি ও হোটেল মোটেল জোনে চলছে পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজি। শুধু মালামাল ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে টোল আদায়ের জন্য বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন যানবাহন ও কুলি স্ট্যান্ড ইজারা নেওয়া হলেও পর্যটকদের গাড়ি পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রতিটি বাস পার্কিং করতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী থেকে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া সামিউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, কক্সবাজার গিয়ে খাবার থেকে শুরু প্রত্যেকটি জিনিসের অতিরিক্ত দাম গুনতে হয়েছে তাদের। এক টুকুরো পোঁয়া মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে দাম দিতে হয়েছে ৩৮০ টাকা। এক লিটার মিনারেল ওয়াটার কিনতে হয়েছে ৫০ টাকায়। গোসল করতে প্রতিজনকে গুনতে হয়েছে ৭০ টাকা। টয়লেট ব্যবহার করতে প্রতিজনকে ৪০-৫০ টাকা করে দিতে হয়েছে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা।
ঢাকা থেকে আসা ফিরোজ আহাম্মদ বলেন, রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের দাম অনেক বেশি। পর্যটকদের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে সুযোগ সন্ধানীরা হোটেলের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন খাবারের দামও। তাদের মধ্যে সেবার মানসিকতা নেই। কোনো কিছু দরদাম না করলেই ঠকতে হবে এবং একটু অসতর্ক হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
সিলেট থেকে আসা পর্যটক আবুল কাশেম বলেন, পরিবার নিয়ে রিগ্যাল প্যালেস হোটেলে উঠেছিলেন। কিন্তু হোটেল কক্ষ বুকিং করতে গিয়ে গুনতে হয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুন বেশি ভাড়া। আমি এর আগেও কক্সবাজার বেড়াতে এসে ওই হোটেলে অবস্থান করেছিলাম। তখন ডাবল-বেডের একটি কক্ষের ভাড়া নিয়েছিল দুই হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু এবার ওই হোটেলে অবস্থান করতে গিয়ে একটি কক্ষের ভাড়া গুনতে হয়েছে চার হাজার টাকা। এ শহরের ব্যবসায়ীদের আরও পর্যটন বান্ধব হওয়া প্রয়োজন বলে- এসময় মন্তব্য করেন তিনি।
আরও পড়ুন>>
** সৈকতেই জীবন-জীবিকা
** রাজশাহী গেলে রেশম, কক্সবাজার শুঁটকি
** যেভাবে ‘পালঙ্কী’ থেকে নাম বদলে ‘কক্সবাজার’
** প্রকৃতিতে হেমন্তের পরশ, সাগরে ছুটছেন পর্যটকরা
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৩
এসএস/আরআইএস