কুয়াকাটা, পটুয়াখালী থেকে: রাতের আয়েশি ঘুমে যারা সূর্যোদয় দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা স্নিগ্ধ হাওয়ায় প্রাণ জুড়াতে একে একে এসে হাজির হচ্ছেন সৈকতে। সাগরকন্যা কুয়াকাটায় নির্মল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর থেকেই পর্যটকদের আনাগোনা কম ছিল। রিমাল চলে গেলেও রেখে গেছে ক্ষত। তবুও সপ্তাহ ঘুরতেই সৈকতে এখন কিছু পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আর সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, প্রতিদিনের তুলনায় একটু একটু করে বাড়ছে পর্যটকের আগমন।
শনিবার (১ জুন) বিকেলে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেখা গেছে পর্যটকদের আনাগোনা। সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, সংখ্যায় কম হলেও নানা বয়সী মানুষ এসেছেন সৈকতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কিছু পর্যটক সৈকতে পায়চারি করছেন। কেউবা আবার সৈকতে বসে আনন্দ উপভোগ করছেন। অনেকেই আবার সাগরে গোসল করছেন। পরিবার-পরিজন ছাড়াও বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছেন অনেকে। কেউ নেমে গেছেন সমুদ্রে, আবার কেউ পা ভিজিয়ে হাঁটছেন সমুদ্র পাড় ধরে। কেউ বা বসে বসে শুনছেন সমুদ্রের গর্জন। পর্যটকদের আগমন ঘিরে বাহারি দোকানে বেড়েছে বিক্রিও।
সমুদ্র সৈকতে থাকা হালকা খাবারের দোকানগুলোতেও দর্শনার্থী রয়েছে। এছাড়া ভোর থেকেই সূর্যোদয় দেখতে ঝাউবনে ছুটে যান অসংখ্য দর্শনার্থী। এরপর লেবুবন, লাল কাঁকড়ার চর, ফাতরার বনের উদ্দেশে পর্যটকদের যেতে দেখা গেছে।
এর আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব প্রভাব ফেলে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে। সৈকত লাগোয়া দোকানগুলো ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যায় অথবা রাতের দিকে উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। বইতে শুরু করে দমকা হাওয়া। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পাড়ে আছড়ে পড়ে বড় বড় ঢেউ।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল চলে গেলেও এর প্রভাবে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বয়ে বেড়াতে হবে বহুদিন। রিমাল শেষ করে দিয়েছে কুয়াকাটা সৈকতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত গাছ। যে গাছ উপকূলের মানুষের বন্ধু হয়ে সব ঝড় জলোচ্ছ্বাসে বুক পেতে দিয়েছে। বুক পেতে ঝড়ের পুরো আঘাত নিজ বুকে সয়ে নিয়ে রক্ষা করে এ উপকূলকে। সেইসব গাছ নিজে মরে বাঁচিয়েছে এ জনপদকে।
কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। এ উদ্যানে ছিল শত শত ঝাউগাছ, কেওড়া ও শাল গাছ। পর্যটকরা এসে ছায়াতলে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। সেই জাতীয় উদ্যান সমুদ্রের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে। গাছগুলো এলোমোলোভাবে পড়ে আছে। জাতীয় উদ্যান থেকে শুরু করে গঙ্গামতি পর্যন্ত সারি সারি গাছ সৈকতে পড়ে আছে। এছাড়া ঝড়ের পর কুয়াকাটা সৈকতে মৃত চিত্রা হরিণও ভেসে এসেছে। তবে সেই সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা পুরো সৈকতের।
দর্শনার্থীরা বলেন, সমুদ্র বার বার টানে। সুযোগ পেলেই তাই ছুটে আসেন সাগরকন্যা কুয়াকাটাতে। দুই/একদিন থেকে প্রশান্ত মনে ফিরে যাওয়া হয় বাড়িতে, কর্মস্থলে। সমুদ্রে ভোরের বাতাস আর সাগরের গর্জন অন্যরকম এক প্রশান্তি এনে দেয় মনে। কর্মজীবনের একঘেয়েমি দূর করতে সমুদ্র ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা আরিফুর রহমান নামে এক পর্যটক বলেন, আমি নিয়মিত কুয়াকাটা ভ্রমণে আসি। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কুয়াকাটা সৈকত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। তাই কিছুদিন ভ্রমণ স্থগিত করেছিলাম। কিন্তু এখন শুনছি, পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। তাই আবারও কুয়াকাটা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ সৈকতে এসে খুবই ভালো লাগছে। সৈকত পরিষ্কার করা হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সমুদ্রের সৌন্দর্য অপরূপ। ঝড়ের ক্ষতি এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। আমি আশা করি, কুয়াকাটা শিগগরিই তার পূর্বের ঐশ্বর্য ফিরে পাবে এবং আরও বেশি পর্যটক এখানে আসবে।
সামিনা এহসান নামে আরেক পর্যটক বলেন, আমি প্রথমবার কুয়াকাটা ভ্রমণে এসেছি। ঝড়ের কথা শুনে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন এসে দেখে মনে হচ্ছে, ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম। সৈকত খুব সুন্দর এবং সমুদ্রের বিশালতা মনোমুগ্ধকর। এখানকার পরিবেশও খুবই মনোরম। আমি খুবই খুশি যে, কুয়াকাটা ভ্রমণে এসেছি। ঝড়ের কথা ভুলে এখন শুধু সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। আমি আশা করি, সরকার কুয়াকাটার পর্যটন শিল্পকে আরও উন্নত করার জন্য পদক্ষেপ নেবে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সেক্রেটারি কে এম জহির জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে পর্যটক শূন্যের কোটায় ছিল। গতকাল থেকে কিছু পর্যটক আশা শুরু করছে। আস্তে আস্তে এটা বৃদ্ধি পাবে।
হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মো. মোতালেব শরীফ জানান, যে কোনো সমস্যা শুরু হলেই ধাক্কা আসে পর্যটনের ওপর। গত সপ্তাহের ধাক্কা কেটে উঠতে আবারও অনেকদিন লেগে যাবে। তবে পর্যটক আসতে শুরু করেছে। গত দুইদিন ধরে বাড়তে শুরু করেছে সৈকতে পর্যটকদের সংখ্যা। এটি দিন যত যাবে ততই বাড়বে বলে আশা করি।
সার্বিক বিষয়ে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সৈকতের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, নির্বিঘ্নেই পর্যটকরা তাদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০২৪
এইচএমএস/এমজেএফ