সিলেট থেকে: রাত ৮টার দিকে জিন্দাবাজারের জল্লারপাড়ে রেস্টুরেন্টটার সামনের রাস্তায় নামতেই জনশোরগোল শোনা যাচ্ছিল। সামনে এগিয়ে যেতেই যেন গমগম করছিলো।
রেস্টুরেন্টের দোতলায় মানুষ, নিচতলায় মানুষ। বাইরে পেতে রাখা আসনে মানুষ। এদের খাবার শেষ হলে বসতে হবে, এমন অপেক্ষায় আঙিনারও বাইরে মানুষ। সমাবেশ মনে হওয়াটা অযৌক্তিক নয় বটে।
এ অঘোষিত, চলমান ও নিয়মিত ‘আহার সমাবেশ’টা চলছিল ‘পানসী রেস্টুরেন্ট’। ‘সুস্বাদু খাবারে আতিথেয়তার পরশ’ স্লোগানে ভোজনবিলাসীদের আপ্যায়ন করে যাওয়া এই ‘পানসী’ পরিচিত সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং আদি সব খাবারের প্রধানতম গন্তব্য হিসেবে।
আসলে কী কী খাবার মেলে ‘পানসী’তে, যে নিত্যদিন সারাটাক্ষণ প্রায় ৪০০ আসনে এমন ‘আহার সমাবেশ’ চলতে থাকে? জানতে ঢু মারতে হলো রসুঁই ঘরটায়।
রসুঁই ঘর থেকে সেসময় তরি-তরকারি পরিবেশনে ভীষণ ব্যস্ত পরিবেশক তোফায়েল আহমদ।
তিনি বলছিলেন একে একে, “শুটকি ভর্তা, শুটকি ভুনা, বেগুন ভর্তা, ডাল ভর্তা, মাছের ডিম ভর্তা, টমেটো ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, মাছ ভর্তা, কলা ভর্তা, শিম ভর্তা, আলু ভর্তা, করলা চিংড়ি, লতা চিংড়ি, গাজর ভর্তা, লুবি ভর্তা, লাউ ভর্তা, ধনিয়া ভর্তাসহ প্রায় ২০-২৫ পদের ভর্তা আর ভাজি আছে। আছে হাঁসের এবং গরুর মাংসের বিশেষ আখনি, বিফ-সাতকরা, রানি মাছসহ নিয়মিত গরুর মাংস ও মুরগির তরকারি এবং হাওরের চিতল ও বোয়াল মাছ। ”
তোফায়েল বলেন, “সব পদই পরিবেশন করতে রসুঁইঘরকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে বেশি টান পড়ে ভর্তার। ”
রেস্টুরেন্টের আঙিনার এক পাশে রুটি-কাবাব-গ্রিল বানানোর ব্যস্ততা। ঠিক এপাশটা ঘেঁষে আইসক্রিম পার্লার এবং জুস কর্নারেও দেখা গেল ভিড়। তোফায়েল বলেন, এখানকার ব্যস্ততার কথাও।
তার সঙ্গে কথার পর আলাপ হয় পানসীর ম্যানেজার হুসাইন আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন তাদের এই ভোজনবিলাসের কথা, “সাধারণত সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সকাল হয় পানসীর হাঁস এবং গরুর মাংসের আখনি দিয়ে। দুপুরে মেলে হাওরের তাজা মাছ। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে বটি কাবাব, সিক কাবাব, জালি কাবাব, টিক্কা, গ্রিল, চিকেন ফ্রাই খাওয়া ধুম। ”
হুসাইনের মতে, ভোক্তাদের কাছে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ মান, স্বাদ এবং দর। পানসী তার খাবারের বেলায় এই তিনটি বিষয়েই সবসময় আন্তরিক। খাবারের মান এবং স্বাদ ধরে রাখার পাশাপাশি এখানে যেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দরের কাছে ঠেকে না যান সেদিকেও যত্নবান রেস্টুরেন্টটি।
তিনি ভোজনরসিকদের এমন জটলা প্রসঙ্গে বলেন, “যদি ভারী বৃষ্টিপাতও হয়, দোকান-পাট বন্ধ হওয়া শুরু করলেও পানসীতে ভোজনবিলাসীদের জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হয়। ভোর ৫টা থেকে পানসী চালু হয়, চলে প্রায় ১২-১টা পর্যন্ত, প্রায় পুরোটা সময় এভাবে মানুষের ভিড় লেগে থাকে। এতো জটলা তাহলে কেন? পানসীর খাবার মানুষকে আকড়ে রাখে, টানতে থাকে। ”
টানে বলেই নগরীর উপশহরের একটি হোটেলে উঠেও পানসীতে খেতে এসেছেন আরমানুল ইসলাম ও তার পাঁচ বন্ধু। তারা সিলেটের জাফলংসহ কয়েকটি পর্যটন স্পট ঘুরবেন সুবিধা মতো।
আরমানুল বলেন, “সিলেটে এর আগেও দু’বার এসেছি। এবার বন্ধুদের সঙ্গে এসেছি। শহরে থাকলে সাধারণত পানসীতেই খেতে আসি। এবারও এলাম। ”
অতিথিদের আপ্যায়নে যেন কমতি না হয় সেজন্য টেবিলগুলোতে খোঁজখবর রাখছিলেন পানসীর সেলস মার্কেটিং ম্যানেজার মাজহারুল ইসলাম রতন।
পানসীর এই অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। তিনি বলেন, “পানসীর ভর্তার প্রশংসা কেবল সিলেটজোড়া নয়, পুরো দেশজোড়া। এখানে যে মাছ রান্না হয়, সবই তাজা। তাজা মাছ পেতে সিলেটের সেরা দু’টি আড়তে সবসময় পানসীর কর্মীরা থাকেন। মাছ আসা মাত্রই বড় বড় এবং তাজা দেখে সেগুলো তারা পাঠিয়ে দেন। সংরক্ষণ তো দূরের কথা, রাখারই সুযোগ হয় না। তাজা মাছ আনা হয় পাশের হাকালুকিসহ বিভিন্ন হাওর থেকেও। ”
রতন প্রায় ২৫ বছর ধরে এই পেশায়। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “কোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টে পানসীর মতো ভিড় দেখিনি। পানসীর এই ভিড় পরিবেশনের কারণেই নিঃসন্দেহে। ”
রতন তাদের লক্ষ্যের কথা বলেন, “আমরা যতো আমাদের খাবারের মান-স্বাদ ডেভেলপ করতে পারবো, ভোক্তা ততো আমাদের দিকে ঝুঁকবে। এটাই নিয়ম। আমরা সেই কাজটাই করে যেতে চাই। ”
বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবারের আসল স্বাদ পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দিতে ২০১১ সালে চার বন্ধু আবু বকর সিতু, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, রায়হান মাসুদ রাসেল এবং নুরুজ্জামান সিদ্দিকী মিলে পানসী রেস্টুরেন্টের শুরু করেন। ছোট পরিসরে শুরু হলেও বর্তমানে পানসীর মোট শাখা চারটি। আরও একটি রয়েছে সিলেটেই এবং বাকি দু’টি মৌলভীবাজার এবং শ্রীমঙ্গলে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৬
এইচএ/