খোঁজ নিয়ে জানতে পারি গেস্ট হাউজটি অনেকটা রিসোর্টের মতো। আর রিসোর্টের প্রতি আমার দুর্বলতা একটু অন্যরকম! এর অবশ্য নানাবিধ কারণ রয়েছে।
এজন্য সুনামগঞ্জ জেলায় বেড়াতে গিয়ে হাওর বিলাস গেস্ট হাউজকে থাকার জন্য বেছে নেই । চমৎকার পরিবেশ, লোকেশনও ভালো, যদিও রিসোর্টের সুবিধা খুব একটা বিদ্যমান নেই। তথাপি রুম ভাড়া হিসেবে তা অনেক সুবিধাজনক। ২৯ সেপ্টেম্বর গেস্ট হাউজে ওঠে একটু ফ্রেশ হয়ে টাঙ্গুয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছি। এদিকে সকালে তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হওয়ায় নাস্তা করা হয়নি। তাই প্রথমে রৌজভিউ গার্ডেন হোটেলে নাস্তা করার সিদ্ধান্ত নেই।
টাঙ্গুয়ার হাওর গিয়ে দুপুরে খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা না-ও থাকতে পারে ভেবে একটু বেশি খেয়ে নেই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে টাঙ্গুয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেই। রাস্তা ভালো, তাই দেড় ঘণ্টার মধ্যে তাহিরপুর পৌঁছি। ঘাটে পৌঁছে কিছুক্ষণ পর একটু দরদাম করে বড় একটি নৌকা নেই। নৌকার মাঝি ভালো মানুষ, তিনি বোঝাতে লাগলেন বেশি টাকা দিয়ে কেন তার নৌকা নিতে যাচ্ছি। কারণ এ নৌকায় ৪০/৫০ জন যাত্রী বহন করে। তার চেয়ে ছোট নৌকা নিলে অনেক কম খরচে ঘুরে আসা যাবে।
মাঝির সঙ্গে মজার বাহাস হলো। শেষে বোঝাতে সক্ষম হই, হাওরে বড় নৌকা চড়ার সুবিধা অনেক। টাকা মুখ্য নয়, ভয় তো আর লাগবে না। এবার নৌকা টেকেরহাটের দিকে রওয়ানা দিতে যাবে, এমন সময় মজার একটি ঘটনা ঘটে। আমাদের সঙ্গে নৌকায় বেড়ানোর জন্য গাড়ির ড্রাইভার নির্মলের আবদার! সময়ক্ষেপণ না করে তার আবদার মেনে নেই। এতে সে খুব খুশি হয়!
মাঝি নৌকা ছাড়লো। দেখি বরযাত্রীর একটা নৌকা, বিয়ের গেটও নৌকায় আছে। দেখতে ভালোই লাগে! টেকের হাটে যাওয়ার পথের চারিদিক খুবই সুন্দর। প্রাকৃতিক দৃশ্য যেন সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি। এতো সুন্দর লাগে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবুও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! আসলে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে অনেক কিছু করার আছে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আনুষঙ্গিক সাপোর্ট ও প্রচারণা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক মানুষ এখন অধিক মাত্রায় সিলেট ঘুরতে আসে। সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথেও অনেক পর্যটক দেখি। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের অনেকেরই গন্তব্য সুনামগঞ্জের দর্শনীয় বিভিন্ন স্পট।
সুনামগঞ্জ বেশ গোছানো শহর, নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও আশানুরূপ। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের কাছে এ অঞ্চল বেশ আকর্ষর্ণয়।
টেকেরহাট যাওয়ার পথে চারিদিকের মুগ্ধতায় বিমোহিত হয়ে সময় কোন দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছিল আমরা যেন তা ভুলেই গেছিলাম। এর মধ্যে বেশ মজার বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি আমাদের আনন্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। মাঝি থেকে বড় ছাতা নিলাম বটে, কিন্তু শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা লাগাতে ভুল করিনি। মনে মনে ভাবলাম, এতো সুন্দর টাঙ্গুয়ার হাওর, যা আরও আগে দেখতে আসা উচিত ছিল।
এক সময় টেকেরহাটে নৌকা এসে ভিড়লো, বিকেল হয়ে যাচ্ছে বিধায় মাঝি একটু কম সময়ে সবকিছু ঘুরে দেখার পরামর্শ দিলেন। মাঝির পরামর্শ শুনলাম মাত্র, কার্যক্ষেত্রে তা মানা গেলো না! নীলাদ্রির রূপ দেখার জন্য হাঁটা শুরু করি, সৌন্দর্যের মুগ্ধতার সঙ্গে হাঁটার গতিও বেড়ে গেলো। কিছুদূর এগিয়ে দেখি, মোটরসাইকেলে ঘুরে দেখার সুন্দর ব্যবস্থা। বৃষ্টির জন্য রাস্তা অনেকটা পিচ্ছিল, তাই ভাড়ায়চালিত হোন্ডা চড়ার সাহস পেলাম না। তবে মজার অনেক দৃশ্য দেখা গেলো, যা কখনো ভোলা যাবে না। তরুণ-তরুণীদের হোন্ডা চড়ার দৃশ্যও বেশ মজার। তাদের আনন্দের কোনো কমতি নেই।
এসব মধুর ও মনোমুগ্ধকর অনেক দৃশ্য দেখার মধ্যেও আমাদের হাঁটার গতি কমেনি। এক পর্যায়ে আমরা প্রাকৃতিক অপরূপ দৃশ্যের সমাহার নীলাদ্রির বাংলাদেশের প্রান্তসীমায় এসে গেলাম। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দু’দেশের অতন্দ্র প্রহরী বর্ডার গার্ড ও বিএসএফের জোয়ানদের পাহারা দিতে দেখি। এই অবস্থায় আমরা সুন্দর কিছু দৃশ্যের ছবিও তুলি। ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে দেখি রাস্তায় খোঁড়াখুড়ি চলছে, অনেক শ্রমিক কাজ করছে। দু’একজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এখান থেকে পাথর তুলে বিক্রি করা হবে। যা দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার আনন্দ কিছুটা থেমে গেলো। পাথরখেকোদের খপ্পরে পড়ে গেলে তো এই সুন্দর নীলাদ্রি আর তার সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারবে না। মনে বেশ কষ্ট পেলাম।
ঘোরাঘুরির একটি পর্যায়ে ফিরে আসার পথে দেখা হলো ডা. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আবার টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘোরার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠি। মাঝি নৌকা ছাড়লো, প্রবল বেগে বৃষ্টি আসায় নৌকার ভেতরে যাই। ভেতরে বিছানা-বালিশসহ বলতে গেলে বিশ্রাম নেওয়ার মতো আরামদায়ক সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বৃষ্টি আবার থেমে গেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের দিকেই মনোনিবেশ করি। ভালো লাগলো। এক পর্যায়ে ঘাটের কাছে এসে টাঙ্গুয়া রেস্টুরেন্টে একটু ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নেই। পুনরায় সুনামগঞ্জ শহরের দিকে রওয়ানা দেই, গন্তব্য হাওর বিলাস গেস্ট হাউস।
এবারও রাস্তায় কোনো ঝামেলা না হওয়ায় সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর গেস্ট হাউসে পৌঁছি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর ভাবলাম, অহেতুক সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এবার শহর ঘুরে দেখি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার, রিভারভিউ, কুটুমবাড়ি, শহীদ স্মৃতি কেন্দ্র ঘুরে দেখি। রাতের খাবারও কুটুমবাড়ি হোটেলে সেরে নেই।
খাওয়া-দাওয়া শেষে চৈতন্য প্রকাশনীর উদ্যোগে আয়োজিত কবি সরকার আমিনের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে কবিতার বই Sex and Spiritual Poems এর প্রকাশনা উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে আসি। এসে দেখি চমৎকার আয়োজন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলামসহ বিশিষ্টজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। জেলা প্রশাসক মহোদয়কে কাছে পেয়ে আলাপচারিতার এক ফাঁকে নীলাদ্রিতে দেখা পাথরখেকোদের কথা বলি। তিনি আমার কথায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানালেন।
৩০ সেপ্টেম্বর সকালে হাসন রাজার বাড়ি ও হালুয়ার ঘাট দেখতে যাই। হাসন রাজার বাড়িতে তার প্রোপৌত্র সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে নানান বিষয়ে আলাপ করি। সামারীন শিক্ষিত ও সজ্জন মানুষ। শহর ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলে সিলেটে ফিরে আসি।
জল জ্যোৎস্নার এ শহরের মানুষ, এর রূপ সৌন্দর্য ও প্রকৃতি চমৎকার!
সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির
অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০১৭
এএ