এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টির নাম ডিম পাহাড়। আকৃতি দূর থেকে ডিমের মতোই।
বান্দরবান সদর থেকে ৮০ কিলোমিটারের একটু বেশি পথ পাড়ি দিলেই জেলার অন্যতম পর্যটন আকর্ষণের উপজেলা থানচি। অপরূপা সাঙ্গু নদী, আদিম সৌন্দর্যের আন্ধারমানিক, মনোলোভা নাফাখুম, অমিয়াখুম জলপ্রপাত, পাথর-পানির তিন্দু- কি নেই এখানে! এতো সব আকর্ষণের সঙ্গে বছর দুই-তিন ধরে যোগ হয়েছে এই ডিম পাহাড়। মানে দেশের সর্বোচ্চ সড়ক।
চিম্বুক পাহাড়শ্রেণীর ডিম পাহাড়ের পাদদেশেই এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখা মিঠাপানির নদী সাঙ্গু। থানচি সদর থেকে আলীকদম উপজেলাকে যুক্ত করেছে সেনাবাহিনী নির্মিত একটি সড়ক। যাকে বলা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক। বান্দরবানেরই পিক৬৯ এর রেকর্ড ভেঙেছে এটি।
৮০-৯০ ডিগ্রি খাঁড়া, আাঁকা-বাঁকা, গাড়িতে চড়লে সামনে-পিছে তাকাতে ভয় করে, চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে হয়- এসব বিচার-বিশ্লেষণ মাথায় নিয়ে প্রবল উত্তেজনায় পাহাড় ডিঙানোর প্রচণ্ড স্পর্ধা জেঁকে বসলো। থানচি সদর থেকে তাই একটি শক্তিশালী পিকআপ ভ্যানে যাত্রা। সাঙ্গু ব্রিজ থেকে কটেজের চেয়ে আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল পাহাড়টি। চালক সাইদুর পাহাড়ের মানুষ। তাই বেশ দক্ষ। মোবাইলে উচ্চতা নির্দেশক অল্টিমিটার চালু করে তাই যাত্রা শুরু।
ডিম পাহাড়ের যে চূড়া চিরে সড়কটি সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে, সেখানে পর্যটন জনপ্রিয় করতে নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে শুনে যাত্রার ইচ্ছেটা আরও বেড়ে যায়। পাহাড় চূড়া কেন্দ্র করে একটি জেলার পর্যটন কোথায় পৌঁছাতে পারে তা নীলাচল, চিম্বুক, জীবননগর, নীলগিরি দেখিয়ে দিয়েছে। যার অধিকাংশের পেছনে নিরলস অবদান রেখে চলেছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন।
যাই হোক, দুরু দুরু বুকে আমাদের বহন করা পিকআপ ভ্যানটি চলতে শুরু করলো। চড়াই-উৎরাই কাকে বলে তা বুঝতে বেশি সময় লাগলো না। মিনিট দশেক চলার পরই সর্পিল সড়ক এঁকেবেঁকে সোজা আকাশ ছুঁয়েছে তো পরক্ষণেই ধপাস করে নেমে গেছে পাতালপানে। মানে মাঝেমধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সামনে তাকালে আর রাস্তা দেখা যায় না, দেখা যায় আকাশ। মনে হয়ে যেন সড়কটি শেষ হয়েছে আকাশ ছুঁয়ে। আবার খাঁড়াই নেমে গেছে এমনভাবে যে বাঁকের আগে মনে হয় সড়কটি হারিয়ে গেছে কোনো গহ্বরে। আরেকটু এগোলেই বুঝি পড়তে হবে গভীর খাদে!
এভাবে মিনিট ২০ এগোতেই পড়লো সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। কি উদ্দেশ্যে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তা জানিয়ে, নাম ঠিকানা লিখে ফের যাত্রা। আর একটু এগোতেই মাংইন পাড়া। পাড়া বলতে হাতে গোনা কয়েকটি বসতি। একটি গয়াল দেখা গেলো রাস্তার পাশেই বাঁধা। অল্টিমিটার বলছে তখন আমরা ২৪শ ফুট উঁচুতে। এখান থেকে খাঁড়াই নেমে চড়াই উঠলেই পৌঁছে যাবো ডিম পাহাড়ের চূড়ায়। মানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সড়কে। দম ধরে এক হাতে ক্যামেরা তাক করে আরেক হাতে গাড়ির শক্ত রড ধরে বসে থাকা। আধাঘণ্টায় পিকআপ ভ্যানটি যখন গোঁ গোঁ শব্দ করে চড়াই উঠে একটি সমতল স্থানে থামলো, তখন অল্টিমিটার বলছে উচ্চতা ২৬৩০ ফুট! মানে আমরা তখন পৌঁছে গেছি শিখরে।
টানটান উত্তেজনার অনেকটা অবসান। গাড়ি যেখানে থামলো সেখানে রাস্তার দুপাশে দুটি স্থাপনা দেখা গেলো। যাত্রীদের জিরানোর জন্য কোনো ছাউনি হবে হয়তো। কাজ শেষ হয়নি এখনও। সড়ক থেকে দক্ষিণে বেশ বড় একটি খালি তুলনামূলক সমতল জায়গা। সেখানেই গড়ে উঠছে পর্যটন কেন্দ্র। নীলাচল, নীলগিরির মতো এখানেও গড়ে উঠছে দুর্দান্ত সুন্দর সব ভিউ পয়েন্টসহ স্থাপনা। থাকবে থাকার ব্যবস্থাও। সকালের মেঘ গায়ে মাখা কিংবা বিকেলের হালকা রোম্যান্টিক রোদ পোহাতে পোহাতে আড্ডা জমানের জন্য তৈরি হচ্ছে কংক্রিটের তৈরি বসার জায়গা। একটু পরিচর্যায় যে মানুষের তৈরি পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে যে এটা সেরা হয়ে উঠবে তার সব ইঙ্গিত এখানে বিদ্যমান।
থানচি থেকে আলীকদমকে সংযুক্ত করা সড়কটি দিয়ে খুব বেশি যান চলাচল করে না। অনেকটা নির্জন। তাছাড়া চড়াই-উৎরাই বেশি হওয়ায় বাহনের তেল খরচও বেশি হয়। আবার শক্তিশালী ইঞ্জিন ছাড়া যে কোনো বাহন উঠতেও পারবে না এখানে। ডিম পাহাড় পর্যন্ত থানচি থেকে দূরত্ব ১০ কিলোমিটার।
নির্জন এ জায়গায় পর্যটন আকর্ষণ বাড়ানো প্রসঙ্গে থানচির পর্যটনবান্ধব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত অর্থবছরে কিছু টাকা নিয়ে এখানে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করা হয়। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে নীলাচল, নীলগিরির মতো ডিম পাহাড়কেও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ এখানে পর্যটন বাড়লে এলাকার উন্নয়ন হবে, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো মজবুত হবে, কাজ পাবে এলাকার মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার হলে এলাকার অনেক মানুষের নতুন আয়-রোজগারের উপায় হবে। তাই আমরা চাইছি এখানে পর্যটন গড়ে উঠুক।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে। তবু প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসছেন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এখান থেকে পাখির চোখে ১৮০ ডিগ্রিতে দেখা যায় অপরূপ পাহাড় শ্রেণী। সত্যি চোখ ধাঁধানো সে দৃশ্য। আর দূর থেকে ভেসে আসা শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া রোদ ম্লান করে দিয়ে দেয় বাড়ি প্রশান্তি।
আগে থানচিতে থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেটি এখন উন্নত হচ্ছে। নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি কটেজ। জনপ্রতি ২শ টাকা হলে রাত্রিযাপন করা যায় এখানে। অর্ডার দিলে সব ধরনের খাবারও খাওয়া যায়। তাই সব ঠিক থাকলে পর্যটন যে এখানে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
দারুণ কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে নামার সময়ের অনুভূতিও ছিল অন্যরকম। পাহাড় থেকে পাহাড় আর উপর থেকে সর্পিল কালচে সড়ক দেখার মজাটাও আলাদা।
৩৫ কিলোমিটার সড়কটির দুপাশে শুধু লম্বা ঘাস। আর গ্রীষ্মের রুক্ষ পাহাড়ি সড়কের দু’পাশে জন্মানো লম্বা ঘাসজাতীয় এসব কিছু গাছ ছাড়া আমাদের যাত্রার সাক্ষী খুব বেশি কেউ থাকলো না।
যাতায়াত-খরচ:
ঢাকা থেকে ৬০০-৬৫০ টাকায় কলাবাগান, যাত্রাবাড়ী থেকে গাড়িতে বান্দরবান সদর। সদর থেকে ২০০ টাকায় লোকাক বাসে ৪-৫ ঘণ্টায় থানচি। চান্দের গাড়ি হলে ভাড়া গুনতে হবে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। আর ডিম পাহাড় যেতে গুনতে হবে আরও অতিরিক্ত অন্তত ২-৩ হাজার টাকা। থাকতে পারবেন জনপ্রতি ২শ থেকে ৫শ টাকায়। পাহাড়ে বিজিবি-সেনাবাহিনী আছে। তাই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
এএ